সরকারি টাকার সঠিক ব্যবহার, হতদরিদ্ররা টিনের পরিবর্তে পেল পাঁকা ঘর

স্টাপ রিপোর্টার : ধুয়ে-মুছে ঠিক করছেন, চলতি সপ্তাহে রং করার কাজও শেষ হবে। এরপর শরিফা খাতুন পাঁকা ঘরে ঘুমাবেন, যা তার কাছে আকাশকুসুম কল্পনা ছিল। হতদরিদ্র শরিফার সেই কল্পনা আজ বাস্তবে রুপ নিতে যাচ্ছে। যা ভেবে সারাক্ষন মুখে হাঁসি নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন শরিফা খাতুন ও তার পরিবার।
শরিফার মতো ৩০৯ টি হতদরিদ্র পরিবারের মানুষগুলোর কল্পনা আজ বাস্তবে রুপ নিচ্ছে ঝিনাইদহ শৈলকুপা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সরকারি টাকার সঠিক ব্যবহারের কারনে। ‘জমি আছে, ঘর নেই’ প্রকল্পে পাওয়া টিনসেড ঘরটি তারা সেমিপাঁকা ঘরে রুপান্তর করেছেন। টিনের ঘরের পরিবর্তে হতদরিদ্রদের দিচ্ছেন পাঁকাঘর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসমান গণি জানিয়েছেন, টিন দিয়ে তৈরী ঘরের জন্য যে বাজেট তারা পেয়েছিলেন সেই বাজেটেই সেমি পাঁকা ঘর নির্মান করেছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে বরাদ্ধ পাওয়া টাকার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই। এমনটি বাড়তি কোনো বরাদ্ধ ছাড়াই অটোব্রিকস্ এর ইট দিয়েও ঘর নির্মান করছেন তারা। যা পেয়ে খুশি হতদরিদ্র পরিবারগুলো সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে হতদরিদ্রদের টিন সেডের ঘর নির্মান কাজ চলছে। এই প্রকল্পে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় বরাদ্ধ আসে ৩০৯ টি ঘরের জন্য তিন কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরের জন্য আছে এক লাখ টাকা।
শৈলকুপা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানাযায়, সরকারি ভাবে প্রতিটি ঘরের মাপ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১৬ ফুট লম্বা আর সাড়ে ১০ ফুট আড়। এছাড়া বারান্দা রয়েছে ৫ ফুট। সঙ্গে আছে একটি বাথরুম। ইট দিয়ে পোতা পর্যন্ত করে তার উপর টিনের বেড়া দেওয়ার কথা ছিল। উপরের চালও হবে টিনের। এভাবে ঘরগুলো ওই এক লাখ টাকা ব্যয় করেই নির্মান শেষ করতে হবে।
শৈলকুপা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রহমান জানান, তাদের গোটা উপজেলার ৩০৯ টি ঘর করার জন্য সরকারি ভাবে নির্দেশ আসে। এই নির্দেশ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওসমান গণি তাকে নিয়ে আলোচনা করেন। কিভাবে ঘরগুলো বাস্তবায়ন করা যায় সেটার পরিকল্পনা করেন। সেখানে ঠিকাদার বা অন্য কারো মাধ্যমে ঘরগুলো তৈরী করলে সব অর্থ ব্যয় করেও ভালো ঘর নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে আসে। এ সময় নকশা অনুযায়ী টিনের ঘর তৈরী করতে তারা স্থানিয় একটি বাজেট করেন। সেখানে দেখা যায় সচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার পরও টিনের ঘরে তৈরীতে তাদের ব্যয় হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। বরাদ্ধ এক লাখের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। এ সময় ওসমান গণি তাকে ইটের পাঁকা ঘর তৈরী করতে কত খরচ হবে তার একটা পৃথক বাজেট করতে বলেন। সেখানে দেখা যায় স্থান ভেদে কোনটিতে এক লাখের ১ থেকে ২ হাজার বেশি আবার কোনোটিতে ১ থেকে ২ হাজার কম লাগছে। উপজেলা শহর থেকে গ্রামের দুরত্বের কারনে খরচ বেশ-কম হবে।
আব্দুর রহমান জানান, তার এই বাজেট দেখে ইউএনও তাৎক্ষনিক ভাবে সিদ্ধান্ত দেন তারা ঘরগুলো পাঁকা করবে। হতদরিদ্র টিনের পরিবর্তে পাঁকা ঘর পাবে। যা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। তিনি বলেন ইউএনও ওসমান গণি’র এই প্রস্তাবে তিনি রাজি হতে চাননি, তিনি তাকে স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন মুল নকশার পরিবর্ত হচ্ছে এই কাজে। তারপরও ইউএনও পাঁকা ঘর নির্মানে জোর দেন এবং উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেন। তারপরও শুরু হয়ে যায় তাদের কর্মযজ্ঞ। গত অক্টোবর মাসে শুরু হয়ে এই কাজ বর্তমানে ২/১ টি ছাড়া শেষ হয়েছে। উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নে ১৮ টি করে ২৩৪ টি আর সারুটিয়া ইউনিয়নে ৭৫ টি মোট ৩০৯ টি ঘর তৈরী করা হয়েছে। তিনি জানান, ওসমান গণি নিজে তদারকির মাধ্যমে এক সঙ্গে সবগুলো ঘরের মালামাল ক্রয় করায় ব্যয় অনেকটা কম হয়েছে। যে কারনে এক লাখ টাকাতেই তারা সবগুলো ঘর নির্মান করতে পেরেছেন।
প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রহমান আরো জানান, তাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সরকারি টাকা বাঁচানোর প্রবনতার বাইরে গিয়ে তিনি সঠিক ব্যবহার করেছেন। এতে গরিব মানুষগুলো উপকৃত হয়েছে। আর তার এই কাজ দেখে তিনি নিজেও অনুপ্রানিত হয়েছেন এবং অন্যরাও ভাবতে শুরু করেছেন ইচ্ছা থাকলে সরকারি বরাদ্ধের সঠিক ব্যবহার করে সমাজকে ভালো কিছু উপহার দেওয়া সম্ভব। তিনি আরো বলেন, এই ওসমান গণি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) থাকা অবস্থায় ওই অফিসকে ঘুষ মুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও সরকারি কাজে ভুমিকা রেখে তিনি ২০১৬ সালে সারা দেশে ও খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ট সহকারি কমিশনার (ভুমি) নির্বাচিত হন। আর ২০১৭ সালে খুলনা বিভাগীয় শ্রেষ্ট কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু পরুষ্কার পেয়েছেন।
এ বিষয়ে সারুটিয়া ইউনিয়নের পুরাতন বাখরবা গ্রামের জহুরুল বিশ^াসের স্ত্রী শরিফা খাতুন জানান, তার স্বামী দিনমজুর। হাজার চেষ্টা করেও পাঁকা ঘরে ঘুমানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। মাত্র ২ শতক জমির উপর বেড়ার ঘরে দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে বসবাস করতেন। এই শীতে বেড়ার ভিতর বাতাশ প্রবেশ করায় ঠিকমতো ঘুমানো যেতো না। এখন তারা পাঁকা বাড়ি পেয়েছেন। আশা করছেন সামনের সপ্তাহে পাঁকা ঘরে ঘুমাবেন। উমেদপুর ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের কাঞ্চন পারভিন জানান, মাত্র ৩ শতক জমির উপর পাটখড়ির বেড়ার ঘর ছিল তাদের। অটো ব্রিকস্ এর ইট দিয়ে পাঁকা ঘর করে দিয়েছেন সরকার। সেই ঘরে তারা ঘুমাচ্ছেন। যা তাদের কাছে ছিল শুধুই কল্পনা। একই গ্রামের আয়শা খাতুন জানান, টিনের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরী করলে পাঁকা ঘরে ঘুমানোর তাদের যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যেতো। তাছাড়া ঘরগুলোও দ্রুত নষ্ট হতো। এখন স্থায়ি একটি ঘর পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহামুদুল হাসান মামুন জানান, প্রকল্পের বরাদ্ধ আসার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসমান গণি তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। তিনি টিনের ঘর না করে ইটের পাঁকা ঘর করবেন বলে তাদের জানান এবং সহযোগিতা আশা করেন। তার এই কাজে সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেছেন। এতে চেয়ারম্যান হিসেবে তারাও উপকৃত হয়েছেন। যে ঘরগুলো হতদরিদ্রদের দেওয়া হচ্ছে তা পেয়ে তারা খুবই খুশি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পাশাপাশি তারাও প্রশংশিত হচ্ছেন বলে তিনি জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওসমান গণি জানান, এই ভালো কাজটির জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা পেয়েছেন। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ এর নির্দেশনার এবং পরামর্শে তিনি এই কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছেন। তিনি আরো জানান, যারা ঘর পেয়েছেন তাদের মুখের হাঁশি আর সরকারের জন্য দোয়া তাকে মুগ্ধ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.