আখ বিক্রির ২৫ কোটি টাকা পাচ্ছে না চাষিরা, মাসের পর মাস ধর্ণা দিতে হচ্ছে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের কর্মকর্তাদের নিকট

স্টাফ রিপোর্টার : কৃষক আব্দুল মান্নান টাকার জন্য এসেছিলেন চিনিকলে। দুইদিন ঘুরেছেন, কিন্তু টাকা পাননি। টাকার জন্য চিনিকলের মহা-ব্যবস্থাপকের গাড়ির সামনে আঁচড়ে পড়েছিলেন, তারপরও টাকা ছাড়াই শুন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। চিনিকলের কাছে তিনি আখ বিক্রি করেছেন, যার মুল্য হিসেবে তার পাওনা এখনও ৮০ হাজার টাকা। বেশ কয়েক মাস এভাবে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ওই চাষি।
একই অবস্থা আরেক কৃষক শাহজাহান আলী শেখ এর। চিনিকলের কাছে তার পাওয়া ২২ লাখ টাকা। হাজার চেষ্টা করেও টাকা পাচ্ছেন না চিনিকলের এই বড় আখ চাষি। শুধু এই দুই চাষি নন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলের নিকট ৪ হাজারের অধিক চাষি’র প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাওয়া রয়েছে। যার সবই আখ বিক্রির টাকা। গত ডিসেম্বর মাস থেকে চাষিরা চিনিকলে এই আখ বিক্রি করেছেন। অদ্যবদি তাদের সেই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি চিনিকল কর্তৃপক্ষ। সময় মতো আখ বিক্রির টাকা না পেলে কৃষকরা আখ চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত মোবারকগঞ্জ চিনিকল। ১৯৬৩ সাল থেকে অদ্যবদি এই চিনিকলের কৃষকরা আখ বিক্রি করে যাচ্ছেন। ইতিপূর্বে টাকা পেতে কিছুটা সমস্যা হলেও বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। চিনিকলের একটি সুত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চিনিকলের আওতাধীন ৪ হাজারের অধিক আখ চাষি রয়েছে। সদ্য শেষ করা আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষিদের নিকট থেকে ১ লাখ ১ হাজার ৭৮৮ মেঃ মন আখ ক্রয় করেছেন। এই আখের মুল্য ৩৬ কোটি ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ টাকা। গত ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে চাষিদের নিকট থেকে এই আখ ক্রয় শুরু হয়, শেষ হয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারি। আখ ক্রয় সময়কালে তাদের ১১ কোটির কিছু বেশি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হলেও এখনও বাকি আছে ২৫ কোটি টাকা।
কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছেন, চাষিদের নিকট থেকে ক্রয় করা আখ থেকে চিনিকল এ বছর ৫ হাজার ৭৮৫ মেঃ টন চিনি উৎপাদন করেছেন। যার মধ্যে ৫ হাজার ৩৪৬ মেঃ টন এখনও বিক্রি করতে পারেননি। অবিক্রিত চিনির মুল্যে ২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
কৃষকদের অভিযোগ কঠোর পরিশ্রম করে তারা জমিতে ফসল (আখ) ফলিয়ে থাকেন। সেই ফসল চিনিকলে বিক্রি করেন। কিন্তু তাদের সময়মতো টাকা দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস টাকার জন্য ঘুরে তারা আখ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক চাষি আগামীতে তারা আর আখ চাষ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জেলার শৈলকুপা উপজেলার কৃষক আব্দুল মান্নান জানান, তারা লাভের আশা নিয়ে চাষ করেন। চিনিকলের কর্মকর্তাদের অনুরোধে লাভজনক ফসল রেখে আখ চাষ করেন। কিন্তু আখ বিক্রির পর টাকা পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়। দিনের পর দিন ঘুরতে হয় চিনিকলে। তিনি বলেন, অধিকাংশ চাষি লেবার দিয়ে ক্ষেত থেকে আখ কাটিয়ে থাকেন। এই আখ পরিষ্কার করে পরিবহনযোগে ক্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এরএতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। তাদের আশা থাকে আখ বিক্রির টাকা পেলে খরচের টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ সময়মতো আখের টাকা না দেওয়ায় তারা সমস্যায় পড়ছেন। যারা তাদের নিকট টাকা পাবেন তারা প্রায়ই নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি টাকার জন্য ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর আখ চাষ করবেন না। চিনিকলের সবচে বড় চাষি বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের শাহজাহান আলী শেখ। তিনি জানান, প্রায় ২ শত বিঘা জমিতে আখের চাষ করেন। এই আখ চিনিকলে বিক্রি করেন। বর্তমানে তার ২২ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এই টাকার জন্য ঘুরে এখন আর চিনিকলে যান না। কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো টাকা না দিলে চাষ থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হবেন বলে জানান।
মোবারকগঞ্জ চিনিকল আখ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাছুদুর রহমান জানান, তারা চাষিদের টাকার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এভাবে চাষিদের টাকা দিতে বিলম্ব করলে চাষিরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সেটা হলে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। যা সকলের জন্য খারাপ খবর বয়ে আনবে।
এ বিষয়ে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহা-ব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী শিকদার জানান, চাষিদের টাকা দিতে না পেরে তারাও ভালো নেই। মাঝে মধ্যেই পাওনাদার চাষি এসে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে পড়ছে, কখনও খারাপ কথা বলছেন। কিন্তু তারা কিছু করতে পারছেন না। চিনি বিক্রি না হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি বলে জানান। তবে আগামী সপ্তাহে কিছু টাকা দিতে পারবেন আশা করছেন ওই কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.