ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আলহাজ্ব জায়েদ আলী ছিলেন শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ

ইদ্রাকপুর জাতীয় আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম বলতেই যে মানুষটির নাম অকপটে মাথায় আসে তিনি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোঃ জায়েদ আলী স্যার৷ মাত্র সতের বছর বয়সে নিজ এলাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন৷ তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৮সালের নভেম্বরে একটি মিটিং এর ডাক দিলেন৷ মিটিং এ মান্দারতলা গ্রামবাসীসহ আশেপাশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অংশ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হবে৷ ঠিক হল কারা কি দিবে, জমি অর্থ ইত্যাদি৷ প্রতিষ্ঠার কাজে সার্বিক সহযোগিতার জন্য একটি নাম বলতেই হয় , আর তিনি হলেন মরহুম আফিল উদ্দিন মেম্বর ৷ স্যারের মুখ হতে অসংখ্য বার বিচ্ছুরিত হয়েছে এই নামটি৷
অবশেষে১৯৬৮সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠা হল ইদ্রাকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়৷ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু হল ক্লাস৷ স্কূলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন আব্দুস সোবহান সাহেব, এরপর প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক মরহুম সামসুল হুদা সাহেব৷ এসব সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দূর্বার গতিতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন স্কুলের কার্যক্রম৷ স্কুলের রেজিস্ট্রেশন হল, নাম হল " ইদ্রাকপুর জাতীয় আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়" ৷ যা ১৯৭৬ সনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়৷
জনাব মোঃ জায়েদ আলী ১৯৫১ সালের ১মার্চ তৎকালীন কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাদপুর মহকুমায় (বর্তমানে চাদপুর একটি জেলা) জন্মগ্রহণ করেন৷ এরপর ১৯৫৫ সালের দিকে স্বপরিবারে তৎকালীন যশোর জেলাধীন মহেশপুর থানার অন্তর্গত গয়েশপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন৷ তাঁর পিতার নাম মরহুম কোবাদ আলী ৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে মহেশপুর থানার অন্তর্গত জিন্নানগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ ১৯৬৩ সালে একই থানাধীন চৌগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমানে শাহাদাত পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়) সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি৷ চৌগাছা বর্তমানে যশোর জেলাধীন একটি প্রশাসনিক থানা ও উপজেলা ৷ ১৯৬৭সালে মেট্রিক ( এস এস সি)পাশের পর ভর্তি হলেন যশোর এম এম কলেজে আই এ শ্রেণীতে৷ এই সময় থেকেই ছুটিতে বাড়ি এসে তৎকালীন হাবাশপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন৷ ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন অন্তত এস এস সি পাশটা করলে এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করব৷ সেই স্বপ্ন থেকেই স্কুলে শিক্ষকতার পথে পা বাড়ান তিনি৷
হাবাশপুরে স্কুল ভিজিট করানোর মত শিক্ষার্থী না থাকায় অনেকের সাথে আলোচনার করে স্কুলটি মান্দারতলা বাজার সংলগ্ন এলাকায় নেওয়ার পরিকল্পনা করেন৷ এর পর ১৯৬৮ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মান্দারতার মরহুম আফিল উদ্দিন মেম্বর এর আম বাগানে মিটিং ডাকেন৷ মিটিং এর জন্য এক সপ্তাহ আগে থেকে মানুষকে আমন্ত্রণ জানান তিনি৷ মিটিং এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৬৯সালের ১ জানুয়ারী মিলাদের মাধ্যমে স্কুলের ক্লাস কার্যক্রম চালু করেন৷
স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিষ্ঠাসহিত পাঠদান শুরু করেন৷ ১৯৬৯ ইং থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২বছর ২মাস শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন৷ অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার শিক্ষকতা শেষে ২৮ ফেব্রুয়ারী স্বসম্মানে অবসরে যান৷ স্যার দীর্ঘ দিন বইয়ের ব্যবসা করেছেন৷ জাহিদ বুক ডিপো নামে মান্দারতলা বাজারে একটি লাইব্রেরি ছিল এক সময়৷
ব্যক্তি হিসাবে আলহাজ্ব মোঃ জায়েদ আলী ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়- নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল, পরোপকারি, সৎ ও সদালাপী, কর্মঠ , সত্যের পক্ষে আনুগত্যশীল আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ও আপোসহীন নাটিমা ও যাদবপুর ইউনিয়নের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এই মহান শিক্ষকের ছোয়া পেয়েছেন, দেখেছেন আলোর নতুন মুখ৷
তিনি সব সময় দাড়িয়ে দাড়িয়ে ক্লাস নিতেন এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লাসকে সুন্দর ও চমকপ্রদ করে তুলতেন৷ যার জন্য তিনি তিনবার গুণী শিক্ষক হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন৷ তন্মধ্যে যশোর হতে একবার ও ঝিনাইদহ হতে দূই বার৷ তাইতো শিক্ষক হিসাবে তিনি সবার নিকট পরম শ্রদ্ধার পাত্র৷
২০০৪ সালে তিনি উদ্যোগ নিয়ে মহেশপুর - যাদবপুর রোডের মান্দারতলা থেকে জাগুসা গ্রাম পর্যন্ত মেইন সড়কের দূপাশে শতশত তাল গাছ রোপন করেন৷ রাস্তায় চলার পথে দূপাশে স্বগৌরবে দাড়িয়ে থাকা তালগাছের ছায়া দেখলেই স্যারের কথা স্বরণে আসে ৷ ২০০৭ সালের সিডরের পর থেকে এই তালগাছগূলি রাস্তার দুপ্বার্শের প্রটেকশন হিসাবে কাজে দিচ্ছে৷
তিনি ২০০৮সালে প্রথম হজ্ব পালন করতে পবিত্র মক্কা মদীনায় যান৷ এরপর ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার হজ্ব পালন করেন৷ হজ্বের শিক্ষা হিসাবে তিনি বলেন, ' হজ্ব মানুষের মাঝে সততার শিক্ষা নিয়ে ভাল মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ করে৷"
স্কুলের বিভিন্ন বিষয়াদি এবং কালের পরিক্রমায় স্কূলের বহমান ইতিহাস সম্বলিত একটি বই লিখেছেন "জীবন ডায়েরীর মর্মকথা" নামে৷ যা আগামি ঈদূল ফিতরের পরেরদিন স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী,২০১৯ এ মোড়ক উন্মোচন ও বিতরণ করা হবে৷ এ উপলক্ষ্যে ১০০০কপি বই ছাপিয়ে রেখেছেন৷
স্যারের নিজ গ্রামে "গয়েশপুর গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা " নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন৷ প্রায় দশ বছর ধরে তিনি সংস্থাটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন৷
তিনি স্কূলে ভূগোল ও বাংলা ব্যাকরণ চমৎকার ভাবে পাঠদান করাতেন৷ স্কূলের চাকরি শেষ হলেও স্কূলের প্রতি মায়া তাঁর আজও শেষ হয়নি৷তাইতো প্রায়ই স্কূলে গিয়ে খোজখবর নেন৷
জানুয়ারী ৩১তারিখ এ হঠাৎ করেই কালীগন্জ বাস টার্মিনালে স্যারের সাথে দেখা হয়৷ স্যার বাড়ি যাচ্ছিলেন, আমি স্যারের ব্যাগ-বাস্তা বাসে তুলে দিলাম৷ দেখা হলেই স্যার প্রশ্ন করেন "কেমন আছো"? বরাবরের মত পরের প্রশ্ন " মামুন কেমন আছে"? মামুন আমার সহোদর বড় ভাই৷ এর পর গত ২১/৫/১৯ তারিখে ঝিনাইদহের পাগলাকানাই তাঁর কন্যার বাড়িতে প্রায় আড়াই ঘন্টা স্যারের নিজের ও সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম শামসুল হুদা স্যারের কর্মজীবন নিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি৷

গত ৮মার্চ রাতে স্যারের প্রথম পর্বটি ফেইসবুকে আপলোডের পর অনেকে স্যারের গূণকীর্তন ও লেখকের প্রশংসা করে মন্তব্য করেন৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য,
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি ১৯৮৩ ব্যাচের ছাত্র ও ইন্জিনিয়ার আইয়ুব হোসেন মন্তব্যে লেখেন, "Zahid Sir, one of the best teachers of my life. He used to love me as a son and guided me to see a big picture of life. Our Head Sir also was a mentor of my life. I remember them from my heart. Wishing Zahid Sir a healthy and long life and pray to Allah for eternal peace of Head Sir's departed soul. Praying for all of my teachers."
সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার ও '৭৯ ব্যাচের ছাত্র জনাব মোঃ আতাউর রহমান লেখেন, "অসাধারণ লেখনী, প্রিয় মাসুম। আসলে জায়েদ স্যারের গুনকীর্তন করে শেষ করা যায় না। যেমন আদর,তেমন শাসন, তেমনি পাঠদানের ধরণ। সালাম স্যার, হাজারো ছালাম জায়েদ স্যার কে। আল্লাহ পাক তাকে আরো দীর্ঘ জীবি করুন।"
'৮৯ ব্যাচের ছাত্র ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব আমিনুল ইসলাম লিটন লিখেছেন,"আলহাজ্ব জায়েদ আলী স্যার।শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ১০০ভাগ নীতিনিষ্ঠ এবং শিক্ষার্থীদের কাছে "কড়া স্যার"।শৃঙ্খলা আর আদর্শ এই দুই নীতির জয়গান গেয়েছেন এবং যতটা জানি এখনো স্যার তাঁর আদর্শ থেকে এক চুল বিচ্যুত হননি।...... স্যারের জন্য শুভকামনা।"
স্যারের দ্বিতীয় পুত্র ও ইসলামী ব্যাংক পল্টন শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার '৯২ব্যাচের ছাত্র জনাব মামুনুর রহমান তুহিন মন্তব্য করেন, "Feel proud being the son & being the student of suchlike personalities as stated by Masum and others comments. However, Keep my father and all beloved teachers of IPHS in your prayers."
সম্পা খাতুন নামে একজন সরকারি চাকুরি জীবি লিখেন, "স্যার আসলেই কড়া ছিলেন,পড়া আদায় করেই ছাড়তেন।স্যারের পিটানি যে খেয়েছে,সেই প্রতিসিঠত হয়েছে।"
ফয়জুর রহমান নামের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বলেন, "i agree with you ,.....not only teaching method but also punishment style also remarkable."
মোঃ নাসির আহিম্মেদ নামে সাবেক এক ছাত্র ও এডভোকেট লিখেন, "আলহাজ্ব জায়েদ আলী স্যারের পাঠদান ছিল অতুলনীয়।"
এছাড়াও আরও অনেকে স্যারের কর্মনীতির প্রশংসা করে মন্তব্য করেছেন৷
বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহ শহরের পাগলাকানাই কন্যার বাড়ীতে থাকেন ৷ তবে নিয়মিত গ্রামের বাড়ী যাতায়াত করেন৷ স্যারের সুস্থতা ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি৷"


লেখক ঃ
মোঃ তরিকুল ইসলাম

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৷



No comments

Powered by Blogger.