খাওয়া থেকে চাষ, গেন্ডারি আখ লাভজনক হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে কৃষকের মাঝে

ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার ছোট-বড় বাজারগুলোতে অসংখ্য গেন্ডারি আখের দোকান। রাস্তার ধারে ধারে বিক্রি হচ্ছে এই আখ। বিক্রেতারা আখ নিয়ে বসে আছেন, ক্রেতারা ক্রয় করে খাচ্ছেন। ৯০ দশকের পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে গেন্ডারি আখ খাওয়ার প্রচলন শুরু হলেও গত কয়েকটি বছর এর ব্যপকতা বেড়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে স্থানিয় ভাবে এই আখের চাষ হওয়ায়।
আখ চাষিরা বলছেন, ইতিপূর্বে তারা ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ সহ বিভিন্ন জেলা থেকে এই আখ ক্রয় করে এখানে এনে বিক্রি করতেন। এখন নিজেদের মাঠে হওয়ায় বিক্রি বেড়েছে। আর এই আখ চাষ করে কৃষকও লাভবান হচ্ছেন। যে কারনে গত ৪ বছরে হরিনাকুন্ডু উপজেলার এই গেন্ডারি আখের চাষ ব্যপক হারে হচ্ছে।
হরিনাকুন্ডু উপজেলা কৃষি বিভাগ সুত্রে জানাগেছে, এই উপজেলা ধান চাষের পরই পান চাষের উপজেলা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রচুর পরিমানে পান চাষ হয়ে থাকে। ২০১২ সালের পর থেকে গেন্ডারি আখের চাষ শুরু হয়ে এবছর প্রায় ১৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। এর পাশাপাশি চিনিকলে সরবরাহের জন্য আরো ১৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ আছে।
সরেজমিনে হরিনাকুন্ডু উপজেলার শহর ও শহর সংলঘœ দৌলতপুর এলাকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায় মাঠের পর মাঠ গেন্ডারি আখ দন্ডায়মান। বাঁশ দিয়ে টাল করে সোজা করে রাখা হয়েছে। একপ্রান্ত থেকে কাটা হচ্ছে, আরেক প্রান্তে আবার বড় হচ্ছে। এই কাটা আখ বাজারে বিক্রি করছেন।
পারবতীপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল বারী মন্ডল জানান, তিনি গত দুই বছর গেন্ডারি আখের চাষ করছেন। হরিনাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুরে তার আত্মিয় আছে। ওই গ্রামে প্রচুর গান্ডারি আখের চাষ হয়। চাষটি লাভজনক বলে শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেও চাষ করবেন। হরিশপুর গ্রামের আত্মিয়ের মাধ্যমে আখের বীজ সংগ্রহ করেন। এরপর নিজে ২০১৮ সালে ১৮ শতক জমিতে চাষ করেন। তিনি জানান, সাধারণত মার্চ মাসের দিকে এই চাষ শুরু হয়। প্রথমে জমি তৈরী করে নিতে হয়। এরপর অন্য আখের মতো এই গেন্ডারি আখও কেটে মাটিতে গেড়ে দিতে হয়। তারপর গাছ তৈরী হয়। এই গাছের বয়স ১০ মাস হবার পর কাটা যায়। তিনি জানান, ১৮ শতক জমিতে গেন্ডারি আখের চাষ করে এক মৌসুমে তিনি একলাখ টাকা লাভ করেছেন। এ বছরও তিনি সমপরিমান জমিতে চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ১২ হাজার টাকার বিক্রি করেছেন। আশা করছেন এবারও লক্ষাধিক টাকা লাভ হবে।
হরিশপুর গ্রামের গিয়ে দেখা যায় মাঠে প্রচুর পরিমানে গেন্ডারি আখ। কৃষকরা জানান, ২০১২ সালের দিকে তাদের গ্রামের নাজিম উদ্দিন রাস্তার ধার থেকে আখ ক্রয় করে খাচ্ছিলেন। এই আখের চোখ বাড়িতে নিয়ে রোপন করেন। এর থেকে ভালো আখ হয়। এর পরের বছর তিনি ফরিদপুর থেকে আখের বীজ নিয়ে আসেন। প্রথম বছর তিনি নিজে ১০ শতক জমিতে চাষ করেন। এরপর প্রতিবছর এই চাষ বাড়তে থাকে। বর্তমানে তাদের মাঠের অর্ধেক জমিতে আখের চাষ। ওই গ্রামের কৃষক কলম আলী জানান, তার নিজের কোনো জমি নেই। ২৪ শতক জমি বর্গা নিয়ে এবার চাষ করেছেন। তিনি জানান, নিজেই দোকানে রেখে এই আখ বিক্রি করেন। প্রতিটি আখ ৪০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হয়। আর যারা পাইকারি বিক্রি করেন তারা ৩০ থেকে ৪০ টাকা পান। এভাবে তাদের এলাকায় গেন্ডারি আখের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। একই গ্রামের ইতাহার আলী জানান, বাজারে ধানের মুল্য কমে গেছে। অন্য ফসল উৎপাদন করেও কৃষক খরচ উঠাতে পারছে না। সেখানে এক বিঘা জমিতে এক লাখ টাকা খরচ করলে ৪ লাখ টাকার গেন্ডারি আখ পাওয়া যায়। অল্প জমিতে অধিক লাভ হওয়ায় এলাকার কৃষকরা বর্তমানে এই চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। আগামীতে হরিনাকুন্ডু উপজেলার অন্য এলাকাতেও এই চাষ ছড়িয়ে পড়বে বলে তাদের ধারনা।
আরেক কৃষক মসলেম আলী জোয়ার্দ্দার জানান, প্রথমে অন্য কৃষকদের আখ চাষ দেখে ভালো কিছু হবে ভাবতে পারেননি। এই আখ অধিক মিষ্টি হওয়ায় ইদুর, শিয়াল, কাঠবিড়াল, পাখিতে নষ্ট করে দেবে। তাছাড়া মানুষও চুরি করে খেয়ে নেবে। এসব ভেবে প্রথমে গুরুত্ব দেননি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আগামী মৌসুমে তিনিও গেন্ডারি আখের চাষ করবেন।
এই গেন্ডারি আখের চাষ নিয়ে আশাবাদি হরিনাকুন্ডু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আরশেদ আলী চৌধুরী। তিনি জানান, মাত্র ৪ থেকে ৫ বছরের ব্যবধানে ১৫ হেক্টর জমিতে এই আখের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। এটা খুবই লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এই চাষে ঝুকে যাচ্ছে। তারাও কৃষকদের এই চাষের পরমর্শ দিচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, ধান-পানের পরই গেন্ডারি আখ চাষ এগিয়ে যাচ্ছে হরিনাকুন্ডু উপজেলায়।

No comments

Powered by Blogger.