কালের সাক্ষী ঝিনাইদহের খালিশপুর নীলকুঠি সংরক্ষণ করা হোক অনন্তকাল

তরিকুল ইসলাম, ইবিঃ
"খালিশপুর নীলকুঠি " ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলায় অবস্থিত যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ৷ ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই নীলকুঠিটি উপজেলার খালিশপুর নামক গ্রামে অবস্থিত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারত উপমহাদেশে নীলচাষ শুরু করার পর অন্যান্য অঞ্চলের মত খালিশপুরেও এই নীলকুঠিটি নির্মাণ করে৷ খালিশপুর বাজারে গেলে প্রায়ই আমি এই কুঠিটি ঘুরে আসি৷ যার প্রাঙ্গনেই গড়ে উঠেছে কলেজ, জাদুঘর আর বাজার ৷
ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী খালিশপুর নীলকুঠিটি কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত। নির্মাণের পর ১৮১০ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত এই নীলকুঠিটি নীলচাষের জন্য ব্যবহার করা হতো৷ উপমহাদেশে নীল বিদ্রোহের সূচনা হওয়ার পর অন্যান্য নীলকুঠির মত নীলকুঠিটি ইংরেজরা রেখে চলে যায়৷ পরবর্তীতে জমিদাররা এটি তাদের কাছারি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় তৎকালীন নীলকুঠির মালিক জমিদারও জায়গাটি ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে এটি মূলত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে৷
বর্তমানে নীলকুঠি ভবন ও এর সংলগ্ন জমিটি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে নথিভুক্ত করে। নীলকুটির পাশেই রয়েছে একটি আমবাগান। নীলকুটি ও আমবাগান মিলিয়ে সংলগ্ন এ জায়গাটি ১০ একরের বেশী জমির উপর অবস্থিত। এই নীলকুঠির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদের শাখা। এ নদ দিয়ে নৌকায় করে আসতো ইংরেজরা। তারা ওই কুঠিতে থাকতো আর কৃষকদের ওপর অত্যাচার করতো নানাভাবে এবং নারীদের ওপরও নির্যাতন করতো তারা৷ এ নীলকুঠি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে৷ এটাকে সংস্কার করা দরকার৷
নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কুঠিতে ১৮১০ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত নীলকরদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা যখন বিদ্রোহ করতে শুরু করে, তখন এদের অত্যাচার কিছুটা কমে আসে৷ যা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ বলে খ্যাত। এছাড়া অন্যান্য কুঠি ছেড়ে যখন ইংরেজরা চলে যায়, তখন জমিদারদের মধ্যে বিক্রি করে দিয়ে যায়; কিন্তু মহেশপুরের খালিশপুর নীলকুঠিটি কোনো ইংরেজ বিক্রি করে দিয়ে যেতে পারেনি। তারা কৃষকদের বিদ্রোহের পর এটি ফেলে পালিয়ে যায়। যার কারণে এই জমিগুলো এখন সরকারি খাস খতিয়ানে আছে। ফলে এ সমস্ত ভবন পুনরায় সংস্কার করে পর্যটন হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। একদিকে যেমন সরকার কিছু রাজস্ব পাবে অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন ভ্রমণ করতে এসে অনেক কিছু জানতে পারবে। এজন্য এলাকার লোকজন এই নীলকুঠির ধসে যাওয়া ভবনগুলো সংস্কারের দাবি তুলেছে৷
এই নীলকুঠি প্রমান করে ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকেই খালিশপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, নীল ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই খালিশপুর একটি বড় পাইকারী বাজারে রূপান্তরিত হয়েছিল৷উল্লেখ্য যে, ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার অন্তর্গত খালিশপুর একটি বাজার৷ খালিশপুর নামে খুলনাতে একটা জায়গা আছে।এই খালিশপুর সেই খালিশপুর নয়৷ অনেকেই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলে। খুলনার খালিশপুর খুলনা জেলার একটি উপজেলা। আর মহেশপুর এর খালিশপুর হল মহেশপুর উপজেলার এস.বি.কে ইউনিয়নের একটি গ্রাম, যেখানে সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে৷ সারা দেশ থেকে পাইকাররা এখানে কাচা-পাকা মাল কিনতে আসে। আর বাজারের পাশেই অবস্থিত ঐতিহাসিক এই নীলকুঠিটি। এছাড়া এই খালিশপুর গ্রামের সাথেই খর্দ্দ খালিশপুর গ্রাম। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ী এই খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে৷ মহেশপুরের সর্ববৃহৎ কলার হাট খালিশপুর বাজারের অদূরে যশোর অন্ঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ বিজিবি সেক্টর (৫৮নং খালিশপুর ব্যাটালিয়ন) যা খালিশপুর - মহেশপুর প্রধান সড়কের পাশেই (বর্তমান নামঃ মহেশপুর ব্যাটালিয়ন সেক্টর ) স্থাপন করা হয়েছে ৷
২০০০ ইং সালে নীলকুঠির পাশেই স্থাপিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মহাবিদ্যালয় ( বর্তমানে সরকারি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ডিগ্রি কলেজ) ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। যা দেখতে ছুটির দিনে লোকজন ভিড় জমায়। যদি নীলকুঠি ভবনগুলো মেরামত করে দেয়া যায় তাহলে এটাও হতে পারে ভ্রমণকারীদের জন্য মনের আবেগ মেটানোর পর্যটনকেন্দ্র ৷
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের দিকে এ নীলকুঠিটি নিলামে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সে সময় এলাকার সচেতন মহল আন্দোলন করে বন্ধ করে দেয়। এলাকাবাসীর দাবি, এটা সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার। সে সময় তৎকালীন মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব আজিয়ার রহমান সাহেব এটি সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে চিঠি দেন৷ তারপর ২০১৬ সালের দিকে তৎকালীন মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশাফুর রহমান সাহেব এখানে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ইকোপার্ক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন৷ বর্তমানে এর সংস্কার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷
কুঠির পাশেই বিশাল আমবাগান রয়েছে, যা দেখতে সবুজ শ্যামল আর অত্যন্ত মনোরম। সম্প্রতি এখানে ইকোপার্ক গড়ে তোলার কাজ চালু হয়েছে৷ ফলে এটি একদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিকট অন্যতম চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে আশা রাখি৷

No comments

Powered by Blogger.