জীবন রাঙ্গাতে রঙ্গিন মাছের চাষ

স্টাফ রিপোর্টার-
পুকুরের পানিতে খেলে বেড়াচ্ছে রং, বে-রংয়ের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামী, হলুদ রংয়ের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিস, কমেট, কৈ কার্ভ, রেপটিকা, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কৈ, মৌলি, মলি, গাপটি, এ্যানজেল সহ ১৬ জাতের মাছ দেখলে মন ভরে যায়। বাসাবাড়ির এ্যাকুরিয়ামে শোভা পেয়ে থাকে এই মাছ। সেই রঙ্গিন মাছের চাষ করেছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের শিহাব উদ্দিন (২৩)।
শাহাব উদ্দিনের ভাষায় এই রঙ্গিন মাছের চাষ তার জীবনকে রাঙ্গিয়ে দেবে। বর্তমানে এই মাছের চাষের মাধ্যমে তার পড়ালেখার খরচ চলছে। দরিদ্র বাবার কষ্ট করে ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতে হচ্ছে না। তাছাড়া ইতিমধ্যে অনেকে এই মাছের চাষ করবেন বলে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। যাদের বেকারত্ব দূর হবে রঙ্গিন মাছ চাষে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের হাসানহাটি গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে শিহাব উদ্দিন। তিনি যশোর এমএম বিশ^বিদ্যালয় কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স করছেন। এবার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার আরেকটি বোন ফারজানা ইয়াসমিন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। আর ছোট ভাই ফরহাদ উদ্দিন নবম শ্রেণীতে পড়ালেখা করে। ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে শিহাব উদ্দিন বাড়ির আঙ্গিনার একটি পরিত্যাক্ত জমিতে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তুলেছিলেন ওরনামেন্টাল ফিস ফার্ম। প্রথম বছরই এই ফার্ম এর মাছ বিক্রি করে তার আয় হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। এবছর মা মাছ ছেড়েছেন পুকুরে। বাচ্চা তৈরী করবেন হাউজে।
শিহাব উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালে এক বাসায় একটি এ্যাকুরিয়াম সপে কয়েকটি রঙ্গিন মাছ দেখে ভালো লাগে তার। কৌতুহলী হয়ে মাছের দাম জানতে চান। এরপর জানতে পারেন মাছগুলি অনেক মূল্যবান। তিনি আরো জানতে চান এগুলো কোথা থেকে এসেছে। ওই বাসার মালিক জানান, রঙ্গিন মাছগুলো বিদেশ থেকে আনা হয়। বর্তমানে দেশেও এই মাছের চাষ হচ্ছে। সেখান থেকেই রঙ্গিন মাছ চাষের পরিকল্পনা মাথায় আসে যুবক শিহাব উদ্দিনের।
তিনি জানান, বছরের শুরুতে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পলিথিন বিছিয়ে একটি চৌবাচ্চা তৈরী করে অল্প কয়েকটি রঙ্গিন মাছ ছাড়েন। দুই মাসের মধ্যে ছোট মাছগুলো বেশ বড় হয়ে যায়। রঙ্গিন মাছগুলো বড় হবার পর দেখতে এতাটা সুন্দর হয় যে তার ভালো লেগে যায়। তখন আরো মা মাছ সংগ্রহ করেন সাতক্ষিরার কলারোয়া এলাকা থেকে। ১৬০ টি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে আসেন। এই মাছ বড় করতে তাকে আরো ৫ টি চৌবাচ্চা (হাউজ) তৈরী করতে হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ১০ ফুট দৈঘ্য আর ৫ ফুট প্রস্তের ৪ টি ও ৫ ফুট দৈঘ্য আর ৪ ফুট প্রস্তের ২ টি মোট ৬ টি হাউজে রেনু ছাড়া হয়। এরপর খামারে থাকা মাছগুলো বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে মাছ ডিম দেয়। ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়, যা বাজারে বিক্রি করেন। যারা এ্যাকুরিয়ামের ব্যবসা করেন তারা এই মাছগুলো ক্রয় করেন। এ থেকে তার প্রায় ১ লাখ টাকা আয় হয়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে তিনি ৬টি হাউজের পাশাপাশি আরো একটি পুকুরে এই মাছের চাষ করছেন। যেখানে তিনি ১৫শত মা মাছ আর ১৫০ টি পুরুষ মাছ ছেড়েছেন। তিনি জানান, তিন থেকে চার মাসের মধ্যে এগুলো বড় হবে। তখন হাউজে দিয়ে ডিম ফুটাবেন। তারপর রেনু বিক্রি করবেন। আশা করছেন এবার কয়েক লাখ টাকার রঙ্গিন মাছ বিক্রি করতে পারবেন।
শিহাব উদ্দিন জানান, বর্তমানে তার খামারে গোল্ড ফিস, কমেট, কৈ কার্ভ, রেপটিকা, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কৈ, মৌলি, মলি, গাপটি, এ্যানজেল, প্লাটিসহ ১৬ প্রজাতির ব্রুড (মা) মাছ রয়েছে। যারা একটি মাছ বছরে প্রায় ৩ হাজার রেণু পোনা দেবে। ৩ থেকে ৪ ইঞ্জি হলে এই মাছ বিক্রি করা হয়। বছরে একবার ডিম দেয় ৭২ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফোটে। এ সময় অক্সিজেন দেওয়া থেকে নানা ভাবে সতর্ক থাকতে হয়। শিহাব জানান, শুরুতে এলাকার মানুষ তার এই চাষ দেখে হাসাহাসি করতেন। সবাই মনে করতেন এটা আমার খেয়ালিপানা। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এখন এলাকার মানুষ ছাড়াও মৎস্য কর্মকর্তারাও তার এই মাছ দেখতে আসছেন। অনেকে খামার দেখতে এসে মাছও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরো জানান, একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন তাকে এই মাছ চাষে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। যে কারনে ভালোভাবে চাষটি করতে পারছেন। সরকারি ভাবে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয় বলে জানান শিহাব উদ্দিন। সব ঠিকঠাক থাকলে এই খামারই জীবনকে বদলে দেবে এমনটি আশা তার।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুর রহমান এর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, শিহাব উদ্দিনের রঙ্গিন মাছের চাষ তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। দেখে খুবই ভালো লাগলো। তিনি বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় এই মাছ চাষ সম্ভব। শিহাব উদ্দিকে নানা পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করছেন বলে জানান। পাশাপাশি তাকে ঋণ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.