বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত সোনার বাংলা চাই

তরিকুল ইসলাম মাসুম -
বঙ্গবন্ধুর শত জন্মবার্ষিকীতে পদার্পণ করেছি আমরা । বিজয়ের ৪৮ বছর পেরিয়ে আমরা ৪৯ এ পদার্পন করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ৷ ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আজকের এই দিনে প্রথম বিজয় অর্জন করেছিল বাঙালি জাতি ও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলা ৷ বিজয়ের ৪৯ তম বছরেও জাতি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কতটুকু এগিয়ে গেল সচেতন নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকের এই বিষয়গুলি ভাবা আবশ্যক । দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বাধাসমূহ চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে বাঙালি জাতি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে যাবে ৷
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা , স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাক-সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করলে বাঙালি জাতি বীরদর্পে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ৷ ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলেও দুইটি আলাদা প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠন করা যৌক্তিক ছিল না ৷ যার ফলশ্রুতিতেই পাকিস্তান সরকারের অধীনে দীর্ঘ ২৪ বছর শাসন আর শোষণের দুর্দশার মধ্যে কেটেছে বাঙালি জাতির ৷ অবশেষে জাতিকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ৷ বাঙালির মুক্তির সনদ খ্যাত এই ভাষণের পরই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে ৷ আর ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় ৷ সেই থেকে ২৬৬ দিনের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালির ঐক্য আর সাহসিকতায় ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম এই পুন্যভূমির সূচনা হয় ৷
বিজয়ের ৪৮ বছর পেরিয়ে আজ দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উন্নীত ৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দুর্বার নের্তৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নশীল থেকে উন্নতির সোপানে ধাবিত হচ্ছে ৷ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২১ সালে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে, ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়নের দেশে আর ১৯৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে ৷ তারই ধারাবাহিকতায় আজ অকল্পনীয় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ৷ ইতোমধ্যে নিজস্ব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন হল , দৃশ্যমান হল পদ্মা সেতুর মত দীর্ঘতম সেতু , নির্মাণ কার্য চলছে রূপপুর পারমাবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অসংখ্য উল্লেখযোগ্য স্থাপনার ৷
তথ্য – প্রযুক্তির এই যুগে সর্বক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন এসেছে ৷ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা - সংস্কৃতি, চিকিৎসা, খেলাধুলায় উন্নতির ছোঁয়া লক্ষ্যণীয় ৷ স্বাধীনতা পরবর্তী মাথাপিছু আয় ১১০ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি আজ তা ১৯০৯ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে ৷ উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলেছে ব্যাপকভাবে, মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৫ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ৷ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বৃদ্ধি পেয়েছে ; সরকারিকরণ করা হয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৷
এতদসত্বেও জাতি কি পেরেছে তার সেই প্রত্যাশিত লক্ষ্যে আরোহণ করতে ? আমরা যদি তার উত্তর খুজি , তাহলে উত্তর আসবে - না ৷ উদাহরণস্বরূপঃ আমরা মালেশিয়াকে মডেল ধরতে পারি ৷ সর্বক্ষেত্রে উন্নতি করে কিভাবে এগিয়ে গেছে মালেশিয়া , তা সবার জন্য অনুপ্রেরণা ৷ আমরাও উন্নত হয়েছি, তবে আমাদের অগণিত উন্নতির পাশাপাশি অজস্র সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ বেড়েছে বেকারত্ব, বেড়েছে মুদ্রা স্ফীতি, বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ৷ শিক্ষার হার পাশের হারের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেলেও গুণগত মানের চরম অবণতি ঘটেছে ৷ মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই তরুণ , যাদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি আর কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবে হতাশা বেড়েছে সীমাহীন ৷ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি দেশকে করে দিয়েছে সর্বশান্ত ৷ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসাক্ষেত্র, কৃষিক্ষেত্রে দুর্নীতি আজ চরমে ৷ গণতন্ত্র দিয়ে প্রতিষ্ঠিত দেশে আজ গণতন্ত্র ভূলুন্ঠিত, নাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র চর্চার মুক্ত পরিবেশ ৷ সর্বত্র চলছে অপশাসন আর স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতা ৷
প্রতিদিনই কোন না কোন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ৷ চুরি, ডাকাতি কমলেও বেড়েছে ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন, ধর্ষণের মত এহেন কোন কর্ম নাই যা প্রতিনিয়ত ঘটছে না ৷ বেড়েছে নেশা, মদ, জুয়া, ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার মত রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ড ৷ যার উদাহরণ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ক্যাসিনো ব্যবসা, মাদক ব্যবসা ৷ যদিও সরকার এসবের বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে এবং এসব নির্মূলে পদক্ষেপ নিয়েছে ৷ শিক্ষাক্ষেত্রে তরুণ তরুণীদের মধ্যে সঠিক জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে নেশা আর অনৈতিকতা বেশি লক্ষ্যণীয় ৷ তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে চরম দুর্নীতির মূলে রয়েছে শিক্ষায় দলীয়করণ বা ঘুষের মাধ্যমে যোগ্যদের পরিবর্তে অযোগ্যদের অনুপ্রবেশ ঘটানো ৷ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা , এমনকি উচ্চতর পাবলিক পরীক্ষায় দুর্নীতি ও নকল করার প্রবণতা চরম ৷ আর প্রাইভেট ভাবে গড়ে ওঠা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে নামসর্বস্ব শিক্ষায় ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট বিক্রি করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবসাক্ষেত্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে ৷ এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজেও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছেন প্রতিনিয়ত ৷ আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে একদিকে অযাচিত টেস্ট আর মেডিসিন দিয়ে মানুষকে সর্বশান্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে হাসপাতাল নির্মাণ আর যন্ত্রপাতি ক্রয়ে চরম দুর্নীতি লক্ষ্যণীয় ৷ ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রেরই চিকিৎসা আশু প্রয়োজন ৷
তথ্য প্রযুক্তিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক, তবে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা এক্ষেত্রে অনেক পিছে ৷ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আইসিটি নৈতিকতা মানা হয় না, আর তরুণ - তরুণীরা তথ্য প্রযুক্তি ব্যহারের চাইতে অপব্যবহারই বেশী করছে ৷ ফলে তরুণেরা ধ্বংসের মুখে নিপতিত হতে চলেছে দিন দিন ৷ সরকারের উচিত হবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সঠিক আইন বাস্তবায়ন আর বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে কারিগরি ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা করে জনসম্পদে রূপান্তর করা ৷ তবেই আমরা পারব আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে অর্জন করতে ৷ জাতি পাবে উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসা আর বাসস্থানের পরিবেশ ৷ দেশ হবে স্বনির্ভর আর স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত স্বপ্নের সোনার বাংলা ৷
লেখকঃ তরিকুল ইসলাম মাসুম
সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ৷
মোবাইলঃ ০১৭৭৩-২৪৫৪৯৬.

No comments

Powered by Blogger.