এশিয়ার বৃহত্তম বেথুলী বটবৃক্ষ পরিদর্শনে

তরিকুল ইসলামঃ
ঝিনাইদহের জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষটি অবস্থিত । কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার পূর্বদিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া-খাজুরা সড়কের পার্শ্বে এই প্রাচীন বটগাছটি দাঁড়িয়ে আছে ।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকোশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিচালিত 'উদ্ভাস ইনভেস্টিগেটর টিম' এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯ইং আমরা যাই এই প্রাচীন নিদর্শনসমূহের ইতিহাস-ঐতিহ্য সন্ধানে ৷ আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুষ্টিয়া থেকে সবাই রওয়ানা দিল সকাল আটটার ক্যাম্পাসের বাসে৷ সাড়ে নয়টায় ঝিনাইদহ শহরে এসে পৌঁছায় ওরা ৷ আমি তাদের রিসিভ করে শহরের একটা রেস্টুরেন্ট এ সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা দিলাম বারবাজারের পথে ৷ শিক্ষা সফরের মৌসুম হওয়ায় সড়কে বাস কম ছিল৷ তাই ঝিনাইদহ থেকে সিএনজিতে চড়ে রওয়ানা দিলাম ৷ কালীগন্জ পৌঁছে পুনরায় অন্য সিএনজিতে চড়ে বারবাজার পৌঁছাই ৷ তারপর একটি ভ্যান রিজার্ভ করে আমরা নিদর্শনগুলি দেখতে যাই ৷ এরপর গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার ঘূরে আমরা কালীজন্জ শহরে ফিরে জুম্মার নামাজ ও দুপুরের খাবার খেয়ে একটা অটো রিজার্ভ করে রওয়ানা দেই সুইতলা মল্লিকপুরের তিনশত বছরের পুরানো বেথুলী বটবৃক্ষ দেখতে ৷

বটগাছটিকে কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেথুলী বা মল্লিকপুর বাজার। পর্যায়ক্রমে বাজারের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে অনেকগুলো দোকান আছে এ বাজারে । অনেকের মতে, বৃক্ষটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর । মূল বৃক্ষটি সময়ের পরিবর্তনে অনেকগুলো ছোট বৃক্ষে বিভক্ত হয়েছে । মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর জমি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে । দক্ষিণ-পূর্ব পাশের বৃক্ষগুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত । বৃক্ষটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং ৪০টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে । মূলবৃক্ষ এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা-প্রশাখায় ঘেরা ।
এক সময় একটি কুয়ার পাশে ছিল এ বিশাল গাছের মূল অংশ । মূল গাছটি কালক্রমে অনেকগুলো ছোট গাছে বিভক্ত হয়ে গেছে। তখন আশপাশে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। রাস্তার ধারের এ গাছটির ডালপালা পূর্ণ থাকত সবুজ পাতায়। গাছের নিচে রোদ-বৃষ্টি কিছুই পড়ত না। মাঘের শীতের রাতেও গাছতলায় আবহাওয়া অন্যরকম থাকত। গ্রীষ্মকালে গাছতলা থাকত ঠাণ্ডা। গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত পথিকরা।
স্থানীয় প্রবীণদের মতে, বর্তমানে সুইতলা নামের কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও ধারণা করা হয় পথশ্রান্ত পথিকরা এ মনোরম স্থানে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত। তখন থেকেই অনেকের কাছে বিশাল বৃক্ষটি সুইতলা বটগাছ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই থেকেই এর নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এখানে। গুরুত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃক্ষটির পাশে ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। এটি সংরক্ষনেরর জন্য এর চারপাশে দেয়াল দেয়া হয়েছে।
এক সময়কার কুয়ার পাড়ের সেই বটগাছটি কালক্রমে 'ঝুরি' (স্থানীয়দের ভাষায় 'বোয়া' বলা হয়) নেমে নেমে পার্শ্ববর্তী এলাকা সমুহ দখল করে নিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগব্যাধি মুক্তির আশায় এ গাছের নামে মানত করে। পাখিদের অন্যতম একটি আবাসস্থল এ বটবৃক্ষটি। অথচ গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। কোনোদিন কেউ শকুন বসতে দেখেনি। গাছের নিচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না।
১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষিত একটি বটগাছ। এ গাছটির আচ্ছাদন ছিল ২.২২ একর জমি জুড়ে। পরে ১৯৮২ সালে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রচারিত হয়, কালীগঞ্জ উপজেলার সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) সেই বটগাছটি অপেক্ষা বড় এবং এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, সুইতলা মল্লিককপুরের বটগাছটিকে 'বিশ্ববট' বলা হয়েছে । ২.৩৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ গাছের বিস্তৃতি । সুইতলা বটবৃক্ষটির অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কারও কাছে সুইতলার বটগাছ, কারও কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ, আবার কারও কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিত এটি। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নানামুখী অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলীন হতে চলেছে।
বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারলে সুইতলা মল্লিকপুরের এ বটগাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। তাই এটি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বটবৃক্ষটির ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে এলাকাবাসি উপকৃত হবে ৷

No comments

Powered by Blogger.