আহলান সাহলাল বরকত ও করুণার আঁধার মাহে রমজান
প্রফেসর ড. সাইফুল গনী নোমান-
আল্লাহ তায়ালার বরকত ও করুণারধারায় আমাদের জীবনগুলোকে সিক্ত করতে বছরের পবিত্রতম এবং শ্রেষ্ঠতম মাস রহমত, বরকত, মাগফেরাতের সওগাত নিয়ে পবিত্র 'মাহে রমজান' আবার ফিরে এলো । বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই মহান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করে থাকে । মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বা মাস মাহে রমজান। রমজানকে স্বাগত জানাতে মুসলিম পরিবার গুলোতে চলছে সাঝ সাঝ রব। মায়েরা সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করছেন। যদিও বতমান করোনার কারণে ইবাদতের জন্য আগে থেকেই ঘরকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে । তথাপি রমজান উপলক্ষে আরো ভালো ভাবে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও ঘরের যাবতীয় কার্যক্রম গুছিয়ে নিচ্ছেন গৃহিণীরা। নিরিবিচ্ছন্ন ইবাদত করে রমজান মাসে পবিত্রতার সহিত আল্লাহর নৈকট্য লাভের করা যায়। প্রতিটি মুমিন মুসলিম সূর্যোদয় তথা সুবহে সাদিক থেকে সুযাস্ত পযন্ত প্রভূর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং বৈধ আকাক্ষা পরিত্যাগ করে আর সাক্ষ্য দেয় যে, শুধু আল্লাহ তায়ালাই তাদের প্রভু আর একমাত্র তার সন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি। ইসলামের পঞ্চভিত্তির তৃতীয় ভিত্তি হলো রোজা, প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান নর-নারীর প্রতি মাহে রমজানের রোজা পালন করা ফরজ। একজন মুসলমানের জন্য নামাজ যেমন ফরজ, ঠিক তেমনিভাবে রমজান মাসের রোজা পালন করাও ফরজ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ তোমাদের প্রতি আমি মাহে রমজানের রোজাকে ফরজ করেছি। যেমন ফরজ করেছিলাম তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতি। এতে আশা করা যায় যে, তোমরা তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)
মহান আল্লাহ এই মাসে তার পবিত্র কালাম 'কোরআনুল কারিম' অবতীর্ণ করার মাধ্যমে এ মাসকে মহিমান্বিত এবং বরকতময় করেছেন। এ মাসে তিনি অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে দেন। এ মাসেই তিনি শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাত ও আকাশের দরজাগুলো খুলে দেন। প্রতিদিন অগণিত জাহান্নামিকে মুক্তি দেন। সুতরাং ফজিলতময় রমজান মাস হলো সিয়াম-সাধনা ও ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অজনের মাস। মহান আল্লহ্ তায়ালা এ মাসে অসীম অনুগ্রহে মানব জাতিকে ধন্য করেছেন, মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের সম্পূর্ণ প্যাকেজ (কুরআনুল কারিম) দান করেছেন। রোজা রাখা কিংবা কুরআন তেলাওয়াত করার জন্য এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব হয়নি; বরং পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মহান ঘটনার কারণে এ মাসের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘অবশ্যই আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কী? তা হচ্ছে এমন রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম।’ (সূরা কদর আয়াত ১-৩)
তাই শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং কুরআনকে অর্থসহ বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, রমজান সেই মাস যে মাসে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের নিদর্শনসমূহ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কুরআন নাজিল হয়েছে। অতএব, যে এই মাস পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
নিঃসন্দেহে কুরআন মানব জাতির শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আর যে নেয়ামত যত বেশি মূল্যবান, তার হক আদায় করার দায়িত্বও তত বেশি। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যপানে পৌঁছার জন্য যে কিতাব সঠিক পথ প্রদর্শন করে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সেই কিতাবের খলিফা হিসেবে আমাদের দায়িত্বও অনেক বেশি।
১. আমাদের নিজেদের আল-কুরআন প্রদর্শিত পথে চলা এবং নিজের মন, চিন্তা, কর্ম, চরিত্র ও তৎপরতাকে কুরআনের আলোকে সাজানোর প্রচেষ্টা চালানো।
২. এই হেদায়েত শুধু নিজের ব্যক্তিজীবনে নয়, বরং তা সবার কাছে পৌঁছানো, এর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো ও অন্ধকার পথসমূহকে আলোকিত করা। দ্বিতীয় দায়ত্বটি প্রথম দায়িত্বের অনিবার্য দাবি। আল্লাহর ঘোষণা- তোমার প্রভূর শ্রেষ্ঠত্ব আর মহত্ত্ব ঘোষণা করো এবং তাদের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করো (সূরা মুদ্দাসির: ২-৩)। মুসলিম উম্মতের সৃষ্টি মূলত এ কারণেই করা হয়েছে।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য বা ফলাফল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। অর্থাৎ রোজা রাখার মাধ্যমে তাকওয়া বা খোদাভীতির গুন অর্জন করা। তাকওয়া এমন একটি জিনিস যার মাধ্যমে সব সমস্যা মোকাবেলা করা যায়, রিজিকের দরজা উন্মুক্ত হয়, দ্বীন ও দুনিয়ার কাজ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। মুত্তাকিদের জন্য এমন সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম (সূরা আরাফ : ৯৬)। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে বরকত ও করুণা লাভের অন্যতম শর্ত হলো তাকওয়া অর্জন করতে হবে। আর তাকওয়া বা নৈকট্য লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় মাহে রমজান। তাই প্রতিটা মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে অবহেলায় না করে আমাদের সঠিক ইবাদতের মাধ্যমে কাটাতে হবে। পবিত্র রমজান মাসের শিক্ষা সারা বছর ধরে রেখে সঠিকভাবে ইসলামের পথে চলার শপথ নিতে হবে। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রাত্রিতে এবাদত করবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রি এবাদতে কাটাবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)। প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্ত্বার কসম যার করতলগত মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহর নিকট রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরির সুঘ্রান হতেও উওম। রোজাদারের খুশির বিষয় দু’টি। যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী)।
অতএব পবিত্র রমজান মাসে রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের অংশিদার হতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে রিপুর পূজা পরিহার করতে হবে, হারাম রুজি থেকে তাওবা করে হালাল রুজি অণ্বেষন করতে হবে, দিবসে সিয়াম সাধনা করে রাত্রি বেলায় মহান রবের দরবারে নামাজ পড়ে কান্না কাটি করতে হবে এবং সাধ্যানুযায়ী দান-খয়রাত করতে হবে। এমনি ভাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে, জাকাত ফরজ হলে তা পূণর্রূপে হকদারের নিকট পৌছে দিতে হবে ।
মাসের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে এত বেশি বরকত লুকিয়ে আছে যে, এই মাসে করা নফল কাজগুলো ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজ গুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)।
রমজান সামাজিক, চিন্তাগত অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার একটি উপলক্ষ। মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মোক্ষম সময় রমজান। তাই মুমিন মুসলিম এর উচিত রমজান এলে বেশি বেশি আত্মসমালোচনায় মনযোগী হওয়া। তাকওয়া অর্জনের ফলেই কেবল রোজা আমাদের পাপকে জ্বালিয়ে দেবে। আর রমজান থেকে মুসলিম উম্মাহ্ ঐকান্তিকভাবে শিক্ষা নিয়ে বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকবে, জিহ্বায় লাগাম টেনে ধরবে, হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখবে, ব্যবহারকে সুন্দর করবে,হিংসা-রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা নিবে। যাতে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো অভিন্ন সুতোয় বেঁধে নেয়ার সুযোগ পায়। রমজান জীবনের মিশনকে আয়ত্ত করা ও সময়ানুবতিতার এক বিরাট সুযোগ। তাই এই রমজান হউক নিজেকে বদলে দেয়ার, পাপ-কালিমাকে মুছে দেয়ার, আর আল্লাহর রহমত পাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে ও পরিবারকে গড়ে তোলার। আহলান সাহলান মাহে রমজান।
লেখক:- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. সাইফুল গনী নোমান।
আল্লাহ তায়ালার বরকত ও করুণারধারায় আমাদের জীবনগুলোকে সিক্ত করতে বছরের পবিত্রতম এবং শ্রেষ্ঠতম মাস রহমত, বরকত, মাগফেরাতের সওগাত নিয়ে পবিত্র 'মাহে রমজান' আবার ফিরে এলো । বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই মহান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করে থাকে । মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বা মাস মাহে রমজান। রমজানকে স্বাগত জানাতে মুসলিম পরিবার গুলোতে চলছে সাঝ সাঝ রব। মায়েরা সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করছেন। যদিও বতমান করোনার কারণে ইবাদতের জন্য আগে থেকেই ঘরকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে । তথাপি রমজান উপলক্ষে আরো ভালো ভাবে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও ঘরের যাবতীয় কার্যক্রম গুছিয়ে নিচ্ছেন গৃহিণীরা। নিরিবিচ্ছন্ন ইবাদত করে রমজান মাসে পবিত্রতার সহিত আল্লাহর নৈকট্য লাভের করা যায়। প্রতিটি মুমিন মুসলিম সূর্যোদয় তথা সুবহে সাদিক থেকে সুযাস্ত পযন্ত প্রভূর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং বৈধ আকাক্ষা পরিত্যাগ করে আর সাক্ষ্য দেয় যে, শুধু আল্লাহ তায়ালাই তাদের প্রভু আর একমাত্র তার সন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি। ইসলামের পঞ্চভিত্তির তৃতীয় ভিত্তি হলো রোজা, প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান নর-নারীর প্রতি মাহে রমজানের রোজা পালন করা ফরজ। একজন মুসলমানের জন্য নামাজ যেমন ফরজ, ঠিক তেমনিভাবে রমজান মাসের রোজা পালন করাও ফরজ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ তোমাদের প্রতি আমি মাহে রমজানের রোজাকে ফরজ করেছি। যেমন ফরজ করেছিলাম তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতি। এতে আশা করা যায় যে, তোমরা তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)
মহান আল্লাহ এই মাসে তার পবিত্র কালাম 'কোরআনুল কারিম' অবতীর্ণ করার মাধ্যমে এ মাসকে মহিমান্বিত এবং বরকতময় করেছেন। এ মাসে তিনি অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে দেন। এ মাসেই তিনি শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাত ও আকাশের দরজাগুলো খুলে দেন। প্রতিদিন অগণিত জাহান্নামিকে মুক্তি দেন। সুতরাং ফজিলতময় রমজান মাস হলো সিয়াম-সাধনা ও ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অজনের মাস। মহান আল্লহ্ তায়ালা এ মাসে অসীম অনুগ্রহে মানব জাতিকে ধন্য করেছেন, মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের সম্পূর্ণ প্যাকেজ (কুরআনুল কারিম) দান করেছেন। রোজা রাখা কিংবা কুরআন তেলাওয়াত করার জন্য এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব হয়নি; বরং পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মহান ঘটনার কারণে এ মাসের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘অবশ্যই আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কী? তা হচ্ছে এমন রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম।’ (সূরা কদর আয়াত ১-৩)
তাই শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং কুরআনকে অর্থসহ বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, রমজান সেই মাস যে মাসে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের নিদর্শনসমূহ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কুরআন নাজিল হয়েছে। অতএব, যে এই মাস পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
নিঃসন্দেহে কুরআন মানব জাতির শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আর যে নেয়ামত যত বেশি মূল্যবান, তার হক আদায় করার দায়িত্বও তত বেশি। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যপানে পৌঁছার জন্য যে কিতাব সঠিক পথ প্রদর্শন করে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সেই কিতাবের খলিফা হিসেবে আমাদের দায়িত্বও অনেক বেশি।
১. আমাদের নিজেদের আল-কুরআন প্রদর্শিত পথে চলা এবং নিজের মন, চিন্তা, কর্ম, চরিত্র ও তৎপরতাকে কুরআনের আলোকে সাজানোর প্রচেষ্টা চালানো।
২. এই হেদায়েত শুধু নিজের ব্যক্তিজীবনে নয়, বরং তা সবার কাছে পৌঁছানো, এর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো ও অন্ধকার পথসমূহকে আলোকিত করা। দ্বিতীয় দায়ত্বটি প্রথম দায়িত্বের অনিবার্য দাবি। আল্লাহর ঘোষণা- তোমার প্রভূর শ্রেষ্ঠত্ব আর মহত্ত্ব ঘোষণা করো এবং তাদের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করো (সূরা মুদ্দাসির: ২-৩)। মুসলিম উম্মতের সৃষ্টি মূলত এ কারণেই করা হয়েছে।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য বা ফলাফল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। অর্থাৎ রোজা রাখার মাধ্যমে তাকওয়া বা খোদাভীতির গুন অর্জন করা। তাকওয়া এমন একটি জিনিস যার মাধ্যমে সব সমস্যা মোকাবেলা করা যায়, রিজিকের দরজা উন্মুক্ত হয়, দ্বীন ও দুনিয়ার কাজ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। মুত্তাকিদের জন্য এমন সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম (সূরা আরাফ : ৯৬)। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে বরকত ও করুণা লাভের অন্যতম শর্ত হলো তাকওয়া অর্জন করতে হবে। আর তাকওয়া বা নৈকট্য লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় মাহে রমজান। তাই প্রতিটা মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে অবহেলায় না করে আমাদের সঠিক ইবাদতের মাধ্যমে কাটাতে হবে। পবিত্র রমজান মাসের শিক্ষা সারা বছর ধরে রেখে সঠিকভাবে ইসলামের পথে চলার শপথ নিতে হবে। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রাত্রিতে এবাদত করবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রি এবাদতে কাটাবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)। প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্ত্বার কসম যার করতলগত মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহর নিকট রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরির সুঘ্রান হতেও উওম। রোজাদারের খুশির বিষয় দু’টি। যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী)।
অতএব পবিত্র রমজান মাসে রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের অংশিদার হতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে রিপুর পূজা পরিহার করতে হবে, হারাম রুজি থেকে তাওবা করে হালাল রুজি অণ্বেষন করতে হবে, দিবসে সিয়াম সাধনা করে রাত্রি বেলায় মহান রবের দরবারে নামাজ পড়ে কান্না কাটি করতে হবে এবং সাধ্যানুযায়ী দান-খয়রাত করতে হবে। এমনি ভাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে, জাকাত ফরজ হলে তা পূণর্রূপে হকদারের নিকট পৌছে দিতে হবে ।
মাসের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে এত বেশি বরকত লুকিয়ে আছে যে, এই মাসে করা নফল কাজগুলো ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজ গুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)।
রমজান সামাজিক, চিন্তাগত অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার একটি উপলক্ষ। মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মোক্ষম সময় রমজান। তাই মুমিন মুসলিম এর উচিত রমজান এলে বেশি বেশি আত্মসমালোচনায় মনযোগী হওয়া। তাকওয়া অর্জনের ফলেই কেবল রোজা আমাদের পাপকে জ্বালিয়ে দেবে। আর রমজান থেকে মুসলিম উম্মাহ্ ঐকান্তিকভাবে শিক্ষা নিয়ে বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকবে, জিহ্বায় লাগাম টেনে ধরবে, হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখবে, ব্যবহারকে সুন্দর করবে,হিংসা-রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা নিবে। যাতে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো অভিন্ন সুতোয় বেঁধে নেয়ার সুযোগ পায়। রমজান জীবনের মিশনকে আয়ত্ত করা ও সময়ানুবতিতার এক বিরাট সুযোগ। তাই এই রমজান হউক নিজেকে বদলে দেয়ার, পাপ-কালিমাকে মুছে দেয়ার, আর আল্লাহর রহমত পাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে ও পরিবারকে গড়ে তোলার। আহলান সাহলান মাহে রমজান।
লেখক:- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. সাইফুল গনী নোমান।
No comments