বর্তমান পরিস্থিতিতে যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

সাইফুল্লাহ শাহাবুদ্দিন-
বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস ব্যাপক আকারে বিস্তার করে মহামারি রূপ ধারন করেছে। প্রতিটা দেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধের তুমুল যুদ্ধ চলছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে গানিতিক হারে। লাশের মিছিলের সারি দিন দিন বেড়েই চলছে। নিরাপত্তার জন্য দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে মানুষ ঘর বন্দী হয়ে আছে। যেতে পারছে না কর্মস্থলে। যার ফলে সাধারণ দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের সংসারে নেমে এসেছে অভাব-অনাটন। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বিত্তশালীদের। তাই দরিদ্রের মুখে হাঁসি ফোটাতে যাকাতের প্রয়োজন অনিবার্য।
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী নেসাব পরিমাণ সম্পদ যদি কারোর কাছে এক বছর গচ্ছিত থাকে তাহলে ঐ মালিককে যাকাত দিতে হবে। যাকাত একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া বা সম্পদ পবিত্র করা। পরিভাষায় নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক কর্তৃক বছরান্তে শরীয়তের পক্ষ থেকে তার মালের উপর নির্ধারিত অংশ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে। ইসলামী শরীয়াতে যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ ইবাদাত ঠিক তেমনি ভাবে যাকাত প্রদান করাও একটি ইবাদত। আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য ধনি ব্যাক্তিদের দুটি মাধ্যম রয়েছে তন্মধ্যে প্রথমত আল্লাহ'র সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা, দ্বীতিয়ত বান্দার সাথে সুস্পর্ক গড়া। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক তৈরী হয় ইবাদাতের মাধ্যমে। অন্যদিকে বান্দার সাথে বান্দার সম্পর্ক তৈরীর মাধ্যম হলো ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, যাকাত প্রদান ও দান সদকার।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে করিমের মধ্যে-৩২ জায়গায় যাকাতের কথা বলেছেন। তন্মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ এবং যাকাতের কথা একত্রে বলেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত নং-২০)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বান্দার কাছে করর্য চেয়েছেন। এবিষয়ে বলা হয়েছে তোমরা 'আল্লাহকে করর্যে হাসানা দাও (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত নং-২০)।
আল্লাহ ত ধনী তাহলে তিনি করর্য নিয়ে কি করবেন? প্রকৃত অর্থে তিনি করর্য চাচ্ছেন গরীর, মিসকীন, অসহায় ইয়াতিমদের জন্য। এই করর্য দিলে কী হবে? আল্লাহ বলেন, তোমরা এর বিনিময় আমার (আল্লাহর) কাছে পাবে (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত নং-২০)। যাকাত-সদকা মূলত আল্লাহকে দেয়া হয়। আল্লাহই তা গ্রহন করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং সদকা গ্রহন করেন (সুরা তাওবা, আয়াত নং- ১০৪)। গরীব মিসকীনগন কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে তা কবজা করেন । যেমন হাদিসে বর্ণিত আছে, যাকাত গরীবের হাতে পৌঁছার আগেই তা দয়াময় আল্লাহর হাতে পৌঁছে যায়। সুতরাং যাকাত যে ব্যাক্তি গ্রহণ করবে তার থেকে বেশি ভাগ্যবান যে প্রদান করে এবং সে নিজেকেও যেনো মুখাপেক্ষী মনে করে।
যাকাতের উদ্দেশ্য:-
ইসলামে যাকাতব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল হিকমত আর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, যাতে সম্পদ তোমাদের গুটি কয়েক লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে পড়ে (সুরা হাশর, আয়াত নং-৭)। ইসলাম চায় সম্পদ সর্বত্র সম্প্রসারিত হোক। সমাজে গরীব-অসহায় মানুষ যেনো দারিদ্রের কষাঘাতে পড়ে সুদখোরদের কাছে অভাববিমোচনের জন্য যেতে না হয়। এছাড়াও ভিক্ষাবৃত্তিতে নিজেকে সমার্পণ না করে। অভাবের তাড়নায় যাতে মানুষ ঈমান হারা না হয়ে যায়। কেননা রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, দারিদ্র্য মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায় (বায়হাকি, হাদিস নং-৬৬১২)

যাকাতের ফযিলত:-
আল্লাহর রাস্তায় খরচের লাভসমূহ, যেহেতু লাভ ছাড়া দুনিয়াতে কেউ কোন কাজ করে না তই আল্লাহ তার বান্দাদের লাভ ছাড়া কিছু করতে বলেন না। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে লাভের পরিমাণও জানিয়ে দিয়েছেন। এবিষয়ে তিনি বলেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় ধন সম্পদ ব্যয় করে তাদের উদাহরণ একটি শস্যদানার ন্যায়। যাতে সাতটি দানা জন্মায়। প্রত্যেকটিতে আবার একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ ( সুরা আল-বাকারা, আয়াত নং-২৬১)।
বান্দার ধারণা যাকাত দিলে সম্পদ হ্রাস পেতে পারে। তাই এই ভয়ে যাকাত দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। অথচ যাকাতের অর্থই হলো বৃদ্ধি পাওয়া বা সম্পদ পবিত্র করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, (হে আমার হাবীব) আপনি তাদের মাল থেকে সদকা (যাকাত) উসুল করুন যাতে আপনি এর মাধ্যমে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশোধিত করতে পারেন। আপনি তাদের জন্য দু'আ করুন। নিঃসন্দেহ আপনার দু'আ তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরুপ। বস্তত আল্লাহ সবকিছু শোনেন এবং জানেন (সুরা তাওবা, আয়াত নং-১০৩)।
যাদের উপর যাকাত ফরজ:-
স্বাধীন, জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারী যখন নিসাব পরিমাণ মালের পূর্ণ মালিক হয় এবং সেটা তার কাছে একবছর গচ্ছিত থাকে তখন এসকল ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ হয়। আর কোন ব্যক্তির নিকট যখন তার বসবাসের স্থান, ব্যবহারৃত কাপর-চোপড়, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তার আয়ের উৎস, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) সমপরিমান নগদ অর্থ বা সম্পদ একবছর স্থানীয় হয় তখন সে মালকে উপর নিসাব পরিমাণ যাকাত ফরয হয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকা ও মস্তিস্ক বিকৃত ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলেও তার উপর যাকাত ফরজ হবে না।

যাকাতের খাতসমূহ:-
১)ফকীর
২)মিসকিন
৩)আমিলীন বা যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত ব্যাক্তি
৪) যাদের চিত্তাকর্ষক প্রয়োজন
৫)দাস মুক্ত করা
৬)ঋণগ্রস্তদের জন্য
৭)আল্লাহর পথে জিহাদকারী ৮)মুসাফির
ফকিরের এর বৈশিষ্ট:- ফকির মানে যার নিকট দৈনন্দিনের খরচ বহন করার মত কোন অর্থ সম্পদ নেই । বর্তমানে ফকিরদের মাঝে আবার বিভিন্ন ভাগ দেখা যায়। একশ্রেণীর ফকীর হলো পেশাদার ফকীর। এদের বাড়ির অবস্থা ভাল তবে সে এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেছে। হাদিসে এদের সম্পর্কে লানত ও অভিশাপ করা হয়েছে। কিয়ামতের ময়দানে এরা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। আর মালদার ফকীর যার নিজের উপর যাকাত আসে তাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না।
যে সমস্ত অসহায় মানুষের প্রশংসায় আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন তারা যাকাত পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগন্য হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, খয়রাত এ সমস্ত ফকীর গরীব লোকদের জন্য যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে। জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়। তারা কিছু চায় না দেখে অবিবেচকরা মনে করে। এদের দিকে তাকালেই এদের ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারবা। এরা কখনো ভিক্ষা চায় না। এদের সাহায্যে তোমরা যে অর্থবিত্ত ব্যয় করবে তা আল্লাহর কাছে গোপন থাকবে না (সুরা বাকারা, আয়াত নং-২৭৩)।
যাকাত না দেওয়ার কুফল:-
যাকাত আদায় না করা ব্যাক্তি ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে অপরাধী এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ বলেন, যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। কেয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুনে তার গচ্ছিত সম্পদ উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাটে ও পার্শ্বদেশে এবং পৃষ্টদেশকে দগ্ধ করা হবে। সে দিন তাদের কে বলা হবে এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন আস্বাদন গ্রহণ করো যা তোমরা জমা করে রেখেছিলে (সুরা তাওবা, আয়াত নং-৩৪-৩৫)। আল্লাহ যাদের উপরে যাকাত ফরজ করেছে তাদের সকলকে যাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুক।

লেখক পরিচিতি:- সাইফুল্লাহ শাহাবুদ্দিন
বি এ অনার্স তৃতীয় বর্ষ
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


No comments

Powered by Blogger.