ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে না খেলে এক সপ্তায়
এম এ কবীর
এক.
কোন কোন দেশে ছবি নির্মিত হয়েছে ? কোন দেশে কোন লেখক ‘লকডাউন’ শব্দটি আগেই ব্যবহার করেছেন? কোয়ারেন্টিন অথবা আইসোলেসন শব্দটি কার কথায়, কার লেখায় এসেছে? এমন এন্তার আলোচনা চলছে।
বাংলাসাহিত্য এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। একশো তিন বছর আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির উপস্থিতি ছিল সরব । ‘কোয়ারেন্টিনের’ বাইরে ‘ছোঁয়াচে রোগ’ শব্দটিও পাওয় যায়।
১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-
‘পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্ - কেরেন্টিন্। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine- তখন পে¬গের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে ‘ÔPort Health OfficerÕ’-এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।
ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, শ্রীকান্তবাবু, একখানা চিঠি যোগাড় না ক’রে আপনার আসা উচিত ছিল না;Quarantine--এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে, কসাইখানায় গরু ছাগল- ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। তবে ছোটলোকেরা কোন রকমে সইতে পারে। শুধু ভদ্রলোকদেরই মর্মান্তিক ব্যাপার।’
দুই.
শরৎচন্দ্রের লেখা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক ? উহান থেকে শিক্ষার্থীরা ফেরার পর তাদের নিয়ে রাখা হয় হজ ক্যাম্পে। সমালোচনা হয় তাদের গাদাগাদি করে থাকা আর খাওয়ার কষ্ট নিয়ে।
শতবর্ষ আগের বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ইংরেজ কলোনি। সেখানে পে¬গ দেখা দেয়ায় নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। এই যন্ত্রণার বেশিরভাগটাই সইতে হতো গরিবদের। শরৎচন্দ্রের ভাষায় কেয়ারেন্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হতো মূলত ‘ছোটলোকদের’। যদিও কিছুটা খোল নলচে বদলেছে। এখন শুধু কোয়ারেন্টিনে কাজ হচ্ছে না। চালু হয়েছে লকডাউন। তাতেও ধনী-গরিবের ফারাক।
করোনা রাজা থেকে প্রজা কাউকেই ভয় করছে না। ক্ষমার তো প্রশ্নই আসে না। না হলে দুনিয়ার তাবৎ পরাক্রমশালীরাও কাবু হতেন না।
কলকাতার বাসিন্দা পরিতোষ পাল জানালেন মজার তথ্য। সেখানে বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা আছেন ‘পেইড কোয়ারেন্টিনে’। শুনে অবাক লাগল। জানতে চাইলাম, দাদা এটা আবার কি? বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা এই লকডাউন পিরিয়ডে কোয়ারেন্টিনের জন্য বেছে নিয়েছে তারকা হোটেলগুলো।
সেখানে তারা ‘পে¬ জোনে’ খেলছে। সময় করে ভালমন্দ খাচ্ছে। আর দিব্যি মউজ মাস্তি করছে। সব যন্ত্রণা দেখা যাচ্ছে গরিবদের বেলায়। দুনিয়ার সব দেশেই দিনমজুর শ্রমিকরা আছে বড় কষ্টে। তাদের খাদ্যে টান পড়েছে। পকেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
তিন.
‘পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত কিনে কত যে রঙ বে-রঙের ছাগল দেখলাম’-
অনেকের মুখেই শৈশবে এমন কথা বহুবার শুনেছি। তখনকার দিনে এক টাকা পঁচিশ পয়সায় কলাই ক্ষেত কেনা যেত না। এক কালে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত। এক টাকায় আট মন চাল কিনত আমাদের পূর্ব পূরুষেরা। তাই বোধ করি পাঁচ সিকেতে কলাই ক্ষেতও কেনা-বেচা হতো।
ছোট বেলায় কথাটা শুনলেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম, কলাই ক্ষেতে একদল সাদা, কালো, বাদামী, হলদে, লাল-নীল রঙের ছাগল কলাই খাচ্ছে। সে এক সৌন্দর্য বটে! কিছুটা নাদান ছিলাম বলেই এই বাক্যটার মর্মার্থ বুঝতে আমার অনেকদিন লেগে যায়।
বড়বেলায় বিদ্বজনের মুখে শুনে আসছি। একটা আপ্ত বাক্য নাকি আমেরিকানরা বলে থাকেন-
ÒEvery crisis is an opportunity to learn. কথাটি সত্যি।
তবে ব্যবহার করা হয় সাধারণতঃ নিদেনকালেই। সু-সময়ে বোধহয় কেউ এই বাক্যটা আওড়ায় না।
চার.
Robert Herrick Gi ÒDelight in DisorderÓ পড়ে কিছুটা মিল খোঁজার চেষ্টা করলেও বুঝেছি দু’টো মেলানো যুক্তি সিদ্ধ হবে না। মানসিক বয়স বাড়ার পর জানলাম Albert Einstein বরহ না-কি আমেরিকানদের ৠণী করে গেছেন, Ò..in the midst of every crisis, lies great opportunity.Ó
শৈশবে বহুবার শোনা পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত আর রঙ-বেরঙের ছাগল দেখার মর্মার্থ মনে হয় ইদানিং হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
পাঁচ.
উন্নত দেশ। জাতিসংঘ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সবাই উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ অতি উদ্বিগ্ন হয়ে বলছেন মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে। ‘বিশ্ব গ্রামের’ (এষড়নধষ ঠরষষধমব) অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়।
দু’মাস সাধারণ ছুটি থাকার কারনে সংক্রমন বিলম্বিত করা গেছে। প্রতিরোধ করা যায়নি।
ছয়.
জীবন ধারায় বড় পরিবর্তন এসেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরে থেকেছে। থাকছে। অখন্ড অবসরে হয়েছে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন । বহু সংখ্যক ইতিবাচক গুণও প্রকাশ পেয়েছে। ঘরে আবদ্ধ মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ । ধর্মের অনুশীলনের পাশাপাশি মানবিক গুনাবলিরও প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
কিছু মানুষের উগ্র লোভ-লালসাও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ফরাসী বিপ্ল¬বের প্রেক্ষাপটে প্যারিস এবং লন্ডনের অবস্থা নিয়ে ঈযধৎষবং উরপশবহং এর লেখা উপন্যাসের প্রারম্ভিক কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বোধহয় অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়-
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে q Charles Dickens এর কথাগুলো খুবই মানানসই।
সাত.
গণমাধ্যম। সামাজিক মাধ্যম। বিজ্ঞান চর্চা করে অনেকেই পারদর্শী হয়ে উঠেছেন চিকিৎসা বিদ্যায়। পাওয়া যাচ্ছে পদ্ধতি। পাওয়া যাচ্ছে ওষুধের নাম । কোনটা নেবো আর কোনটা নেবোনা স্থির করাই কঠিন। -‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা।
কোন সময় ‘সংকলিত’। ‘সংগৃহীত’। ‘কপি’। কখনোবা বিভিন্ন জানা অজানা ডাক্তার-বিশেষজ্ঞের নামেও পরামর্শ চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে। গরম পানি থেরাপি। কীটনাশক ছিটানো। থানকুনি পাতা। কালি জিরা। মধু। আদা। লবঙ্গ। লেবু। ভিটামিন সি। জিঙ্ক। দোয়া। ঝাড়ফুঁক। তাবিজ-কবজ। হোমিওপ্যাথি। আর্সেনিক এ্যালবাম। এ্যালোপ্যাথি তো আছেই। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। রেমডিসিভির। আইভারমেকটিন। ফাভিপিরাভীর- কি নেই চিকিৎসায়।
আট.
সৈয়দ মজতুবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’ অনেকেই হয়তো পড়েছেন। এই বইয়ে ‘বেঁচে থাকো সর্দি কাশি’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। লেখকের জার্মানীতে সর্দি আক্রান্ত হওয়ার পর সদ্য পরিচিত নামকরা ডাক্তারের কাছে যাবেন সিদ্ধান্ত নেন-
“যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারন জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়’।” সৈয়দ সাহেব এই বিশ্বাস নিয়েই পরিচিত ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার সাহেবও নানা রসিকতার পর রোগীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন সে ব্যামো ওষুধে সারে না।”
নয়.
সুস্থ্যতা নিয়ে নানা কথাবার্তা থাকলেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাক্যটা মনে রাখলে বোধহয় সুবিধে হবে-
“রোগের অভাবের নাম স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্য হচ্ছে বিকাশের একটি অবস্থা।”
আর WHO এর দেয়া সংজ্ঞায় -স্বাস্থ্য হ’লো
রবীন্দ্রনাথ কিংবা WHO এর দেয়া সংজ্ঞায় সুস্থ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসায় কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই।
ÔPatientÕ’ মানেই যার যার ধৈর্য্য আছে। ভোগান্তির মুখেও যে ধৈর্য্য ধারণ করে।
বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্য ধারন করলে আল্লাহর সাহায্যও পাওয়া যায়। রোগেরও উপশম হয়।
আল- কোরআনের (সূরা আল-ইমরান-১৪৬) আয়াতে বলা হয়েছে- “আল্লাহ্ ধৈর্য্যশীলদের ভালোবাসেন”,
সূরা আল-আনফাল-এর ৪৬ নং আয়াতে ঘোষনা করা হয়েছে - “তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন”,
সূরা আল-বাকারাহ্-এর ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন “...অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রামে-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করবে।”
দশ.
আতঙ্কিত হবেন না। সামাজিক দূরত্ব মানবেন। ধৈর্য্য ধারণ করবেন। স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। কতদিন ? বেশি দিন নয়। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার প্রধানদের কনফারেন্স হয়েছে। ব্রাজিলে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। সুখবর আসছে। আসতেই হবে। সংকট যতই গভীর হয়। সমাধান ততই কাছাকাছি আসে। রাত যতটা গভীর হয়, সূর্যোদয় ততই ঘনিয়ে আসে।
রোমান্টিক কবি Shelley লিখেছেন-
আমরা করবো জয় একদিন!!!”
আসি সাহিত্যের পাতায়। কোয়ারেন্টিন নিয়ে শরৎচন্দ্র একা নন। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। নবারুণ ভট্টাচার্যসহ অনেকের লেখায় মহামারি এসেছে নানাভাবে। তা- ওলাউটা। বসন্ত। ক্ষয় রোগ। পে¬গ। স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
এম এ কবীর
সাংবাদিক,কলামিষ্ট
trynew70@gmail.com
এক.
কোন কোন দেশে ছবি নির্মিত হয়েছে ? কোন দেশে কোন লেখক ‘লকডাউন’ শব্দটি আগেই ব্যবহার করেছেন? কোয়ারেন্টিন অথবা আইসোলেসন শব্দটি কার কথায়, কার লেখায় এসেছে? এমন এন্তার আলোচনা চলছে।
বাংলাসাহিত্য এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। একশো তিন বছর আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির উপস্থিতি ছিল সরব । ‘কোয়ারেন্টিনের’ বাইরে ‘ছোঁয়াচে রোগ’ শব্দটিও পাওয় যায়।
১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-
‘পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্ - কেরেন্টিন্। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine- তখন পে¬গের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে ‘ÔPort Health OfficerÕ’-এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।
ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, শ্রীকান্তবাবু, একখানা চিঠি যোগাড় না ক’রে আপনার আসা উচিত ছিল না;Quarantine--এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে, কসাইখানায় গরু ছাগল- ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। তবে ছোটলোকেরা কোন রকমে সইতে পারে। শুধু ভদ্রলোকদেরই মর্মান্তিক ব্যাপার।’
দুই.
শরৎচন্দ্রের লেখা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক ? উহান থেকে শিক্ষার্থীরা ফেরার পর তাদের নিয়ে রাখা হয় হজ ক্যাম্পে। সমালোচনা হয় তাদের গাদাগাদি করে থাকা আর খাওয়ার কষ্ট নিয়ে।
শতবর্ষ আগের বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ইংরেজ কলোনি। সেখানে পে¬গ দেখা দেয়ায় নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। এই যন্ত্রণার বেশিরভাগটাই সইতে হতো গরিবদের। শরৎচন্দ্রের ভাষায় কেয়ারেন্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হতো মূলত ‘ছোটলোকদের’। যদিও কিছুটা খোল নলচে বদলেছে। এখন শুধু কোয়ারেন্টিনে কাজ হচ্ছে না। চালু হয়েছে লকডাউন। তাতেও ধনী-গরিবের ফারাক।
করোনা রাজা থেকে প্রজা কাউকেই ভয় করছে না। ক্ষমার তো প্রশ্নই আসে না। না হলে দুনিয়ার তাবৎ পরাক্রমশালীরাও কাবু হতেন না।
কলকাতার বাসিন্দা পরিতোষ পাল জানালেন মজার তথ্য। সেখানে বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা আছেন ‘পেইড কোয়ারেন্টিনে’। শুনে অবাক লাগল। জানতে চাইলাম, দাদা এটা আবার কি? বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা এই লকডাউন পিরিয়ডে কোয়ারেন্টিনের জন্য বেছে নিয়েছে তারকা হোটেলগুলো।
সেখানে তারা ‘পে¬ জোনে’ খেলছে। সময় করে ভালমন্দ খাচ্ছে। আর দিব্যি মউজ মাস্তি করছে। সব যন্ত্রণা দেখা যাচ্ছে গরিবদের বেলায়। দুনিয়ার সব দেশেই দিনমজুর শ্রমিকরা আছে বড় কষ্টে। তাদের খাদ্যে টান পড়েছে। পকেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
তিন.
‘পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত কিনে কত যে রঙ বে-রঙের ছাগল দেখলাম’-
অনেকের মুখেই শৈশবে এমন কথা বহুবার শুনেছি। তখনকার দিনে এক টাকা পঁচিশ পয়সায় কলাই ক্ষেত কেনা যেত না। এক কালে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত। এক টাকায় আট মন চাল কিনত আমাদের পূর্ব পূরুষেরা। তাই বোধ করি পাঁচ সিকেতে কলাই ক্ষেতও কেনা-বেচা হতো।
ছোট বেলায় কথাটা শুনলেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম, কলাই ক্ষেতে একদল সাদা, কালো, বাদামী, হলদে, লাল-নীল রঙের ছাগল কলাই খাচ্ছে। সে এক সৌন্দর্য বটে! কিছুটা নাদান ছিলাম বলেই এই বাক্যটার মর্মার্থ বুঝতে আমার অনেকদিন লেগে যায়।
বড়বেলায় বিদ্বজনের মুখে শুনে আসছি। একটা আপ্ত বাক্য নাকি আমেরিকানরা বলে থাকেন-
ÒEvery crisis is an opportunity to learn. কথাটি সত্যি।
তবে ব্যবহার করা হয় সাধারণতঃ নিদেনকালেই। সু-সময়ে বোধহয় কেউ এই বাক্যটা আওড়ায় না।
চার.
Robert Herrick Gi ÒDelight in DisorderÓ পড়ে কিছুটা মিল খোঁজার চেষ্টা করলেও বুঝেছি দু’টো মেলানো যুক্তি সিদ্ধ হবে না। মানসিক বয়স বাড়ার পর জানলাম Albert Einstein বরহ না-কি আমেরিকানদের ৠণী করে গেছেন, Ò..in the midst of every crisis, lies great opportunity.Ó
শৈশবে বহুবার শোনা পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত আর রঙ-বেরঙের ছাগল দেখার মর্মার্থ মনে হয় ইদানিং হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
পাঁচ.
উন্নত দেশ। জাতিসংঘ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সবাই উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ অতি উদ্বিগ্ন হয়ে বলছেন মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে। ‘বিশ্ব গ্রামের’ (এষড়নধষ ঠরষষধমব) অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়।
দু’মাস সাধারণ ছুটি থাকার কারনে সংক্রমন বিলম্বিত করা গেছে। প্রতিরোধ করা যায়নি।
ছয়.
জীবন ধারায় বড় পরিবর্তন এসেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরে থেকেছে। থাকছে। অখন্ড অবসরে হয়েছে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন । বহু সংখ্যক ইতিবাচক গুণও প্রকাশ পেয়েছে। ঘরে আবদ্ধ মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ । ধর্মের অনুশীলনের পাশাপাশি মানবিক গুনাবলিরও প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
কিছু মানুষের উগ্র লোভ-লালসাও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ফরাসী বিপ্ল¬বের প্রেক্ষাপটে প্যারিস এবং লন্ডনের অবস্থা নিয়ে ঈযধৎষবং উরপশবহং এর লেখা উপন্যাসের প্রারম্ভিক কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বোধহয় অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়-
ÒIt was the best
of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age
of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it
was the season of light, it was the season of darkness, it was the spring of
hope, it was the winter of despair, we had everything before us, we had nothing
before us, we were all going direct to Heaven, we were all going direct the
other way- in short, the period was so far like the present period..Ó (A Tale of Two Cities)|
সাত.
গণমাধ্যম। সামাজিক মাধ্যম। বিজ্ঞান চর্চা করে অনেকেই পারদর্শী হয়ে উঠেছেন চিকিৎসা বিদ্যায়। পাওয়া যাচ্ছে পদ্ধতি। পাওয়া যাচ্ছে ওষুধের নাম । কোনটা নেবো আর কোনটা নেবোনা স্থির করাই কঠিন। -‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা।
কোন সময় ‘সংকলিত’। ‘সংগৃহীত’। ‘কপি’। কখনোবা বিভিন্ন জানা অজানা ডাক্তার-বিশেষজ্ঞের নামেও পরামর্শ চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে। গরম পানি থেরাপি। কীটনাশক ছিটানো। থানকুনি পাতা। কালি জিরা। মধু। আদা। লবঙ্গ। লেবু। ভিটামিন সি। জিঙ্ক। দোয়া। ঝাড়ফুঁক। তাবিজ-কবজ। হোমিওপ্যাথি। আর্সেনিক এ্যালবাম। এ্যালোপ্যাথি তো আছেই। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। রেমডিসিভির। আইভারমেকটিন। ফাভিপিরাভীর- কি নেই চিকিৎসায়।
আট.
সৈয়দ মজতুবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’ অনেকেই হয়তো পড়েছেন। এই বইয়ে ‘বেঁচে থাকো সর্দি কাশি’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। লেখকের জার্মানীতে সর্দি আক্রান্ত হওয়ার পর সদ্য পরিচিত নামকরা ডাক্তারের কাছে যাবেন সিদ্ধান্ত নেন-
“যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারন জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়’।” সৈয়দ সাহেব এই বিশ্বাস নিয়েই পরিচিত ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার সাহেবও নানা রসিকতার পর রোগীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন সে ব্যামো ওষুধে সারে না।”
নয়.
সুস্থ্যতা নিয়ে নানা কথাবার্তা থাকলেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাক্যটা মনে রাখলে বোধহয় সুবিধে হবে-
“রোগের অভাবের নাম স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্য হচ্ছে বিকাশের একটি অবস্থা।”
আর WHO এর দেয়া সংজ্ঞায় -স্বাস্থ্য হ’লো
Òa state of complete physical, mental and
social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.Ó
রবীন্দ্রনাথ কিংবা WHO এর দেয়া সংজ্ঞায় সুস্থ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসায় কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই।
ÔPatientÕ’ মানেই যার যার ধৈর্য্য আছে। ভোগান্তির মুখেও যে ধৈর্য্য ধারণ করে।
বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্য ধারন করলে আল্লাহর সাহায্যও পাওয়া যায়। রোগেরও উপশম হয়।
আল- কোরআনের (সূরা আল-ইমরান-১৪৬) আয়াতে বলা হয়েছে- “আল্লাহ্ ধৈর্য্যশীলদের ভালোবাসেন”,
সূরা আল-আনফাল-এর ৪৬ নং আয়াতে ঘোষনা করা হয়েছে - “তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন”,
সূরা আল-বাকারাহ্-এর ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন “...অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রামে-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করবে।”
দশ.
আতঙ্কিত হবেন না। সামাজিক দূরত্ব মানবেন। ধৈর্য্য ধারণ করবেন। স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। কতদিন ? বেশি দিন নয়। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার প্রধানদের কনফারেন্স হয়েছে। ব্রাজিলে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। সুখবর আসছে। আসতেই হবে। সংকট যতই গভীর হয়। সমাধান ততই কাছাকাছি আসে। রাত যতটা গভীর হয়, সূর্যোদয় ততই ঘনিয়ে আসে।
রোমান্টিক কবি Shelley লিখেছেন-
Ò...If Winter comes, can Spring be far
behind?Ó
“বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়,আমরা করবো জয় একদিন!!!”
আসি সাহিত্যের পাতায়। কোয়ারেন্টিন নিয়ে শরৎচন্দ্র একা নন। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। নবারুণ ভট্টাচার্যসহ অনেকের লেখায় মহামারি এসেছে নানাভাবে। তা- ওলাউটা। বসন্ত। ক্ষয় রোগ। পে¬গ। স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
এম এ কবীর
সাংবাদিক,কলামিষ্ট
trynew70@gmail.com
No comments