ঝিনাইদহের হরিশংকরপুরে হত্যার ঘটনার পর হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট, চার শতাধিক পরিবারের পুরুষরা বাড়িছাড়া, নারীরা আছেন আতংকে

চিত্রা নিউজ ডেস্ক-
বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম পাহারা দিচ্ছেন ভাঙ্গাচুরা বাড়িটি, যে বাড়িটি গত সপ্তাহে লুট হয়েছে। বাড়ির টিউবওয়েল লুট হওয়ায় পাশের নদীর পানিতে তিনি ওজু করছেন, আর হিন্দু সম্প্রদায়ের এক বাড়ি থেকে পানি এনে খাওয়ার কাজ সারছেন। খাট-পালঙ্গ লুট করায় ঘরের মেঝেতে ঘুমাতে হচ্ছে। ছেলেরা হামলা-মামলা ভয়ে বাড়ি ছাড়া। আরেক বৃদ্ধা পারুল বেগম পাহারা দিচ্ছেন তার জামাই নাজিম শেখের বাড়ি। নাজিম শেখের বাড়িঘরেও কিছু নেই, সবকিছু লুট হয়ে গেছে। ভাংচুর ও লুট হওয়া এই ঘটনাগুলো ঝিনাইদহ হরিশংকরপুর ইউনিয়নের পরানপুরে।
আনোয়ারা বেগমের ছেলে আব্দুল বাকি’র ভাষায় তাদের গ্রাম থেকে আনুমানিক ৪ কিলোমিটার দূরে হরিশংকরপুরে ৪ জুন এক সন্ত্রাসী হামলায় দুইজন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনাকে পুজি করে একটি পক্ষ পাশ্ববর্তী ৫ থেকে ৬ টি গ্রামে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না এমন লোকজনের বাড়িঘরেও হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। আর পারুল বেগমের জামাই নাজিম শেখ জানান, তাদের মতো গোটা ইউনিয়নের ৬ টি গ্রামের ৪ শতাধিক পরিবারের পুরুষ ছেলেরা বাড়ি ছাড়া। তাদের মেয়েরা বাড়িতে থাকলেও আছে আতংকে। বিদ্যুতের মিটার ভেঙ্গে দেওয়ায় পরিবার আছেন অন্ধকারে। টিউবওয়েলের মাথা খুলে নেওয়ায় চলছে পানির কষ্ট। 
প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন বিকালে সাড়ে ৫ টার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের হরিশংকরপুর গ্রামে একদল সন্ত্রাসীর হামলায় নিহত হন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের দুই নেতা আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম। ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ অভিযোগ করেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একই দলের আরেক নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাসুম এর সন্ত্রাসী বাহিনী পরিকল্পিত ভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। যে মামলার ১৬ জন আসামী ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ বলছে, বাকি আসামী গ্রেপ্তারে তারা তৎপর রয়েছেন।
২৫ জুন সরেজমিনে হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে গোটা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ইউনিয়নের পরানপুর, শিতারামপুর, চন্দ্রজানি, কোদালিয়া, সুতুলিয়া ও হরিশংকরপুর গ্রামের বেশ কিছু পরিবারে পুরুষ ছেলেরা বাড়ি ফেড়ে পালিয়ে রয়েছে। যে বাড়িগুলোতে বয়োবৃদ্ধ নারীরা অবস্থান করছেন। সাংবাদিক শুনে ভয়ে তারা কেউ সামনে এসে কথা বলতে চাননি, তবে গোপনে বেশ কয়েকজন পরিবারের পুরুষ ছেলেদের মুটোফোন নাম্বার দিয়ে কথা বলার জন্য বলেছেন। চারটি গ্রামে বেশ কিছু বাড়ি ভাংচুর অবস্থায় দেখা গেছে। কিছু বাড়ির বিদ্যুতের মিটার ভাঙ্গা, কিছু বাড়ির টিউবওয়েল এর মাথা নেই। এলাকায় পরানপুর ও হরিশংকরপুরের দুইটি স্থানে পুলিশ অবস্থান করতে দেখা গেছে।
পরানপুর গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, তাদের ইউনিয়নে দুইটি সামাজিক দল রয়েছে। একটির নেতৃত্ব দেন বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাসুম ও অপরটির সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ। এরা দু’জনই আওয়ামীলীগের নেতা। এই দুই নেতার লোকজনের মধ্যে মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষ, বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। গত ১০ বছরে এই ইউনিয়নে উভয়পক্ষের ৫ জন জীবন দিয়েছেন। সর্বশেষ জীবন দিলেন আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম। পূর্বে প্রাণ গেছে ছানার উদ্দিন, জাহিদুল ইসলাম ও বাদল কুন্ডু। আর একটা হত্যাকান্ড ঘটার পর এলাকায় শুরু হয়ে যায় ভাংচুর ও লুটপাট। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত না, সামাজিক দলভুক্ত থাকায় তাদের বাড়িঘরও রক্ষা পায় না। এমনকি সামাজিক মাতবররাও এই হামলা, মামলা আর ভাংচুরের শিকার হন।
পরানপুর গ্রামের নাজেম শেখ জানান, সর্বশেষ আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম হত্যাকান্ডের ঘটনার পর পাশ^বর্তী ৪ গ্রামে ভাংচুর হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে এক গ্রামে আর হামলা বাড়িঘর ভাংচুর হয়েছে ইউনিয়ন এর বিভিন্ন গ্রামে। তার বাড়িও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে, লুট হয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার মালামাল। একই গ্রামের আব্দুল বাকি জানান, তার বাড়িঘরও ভেঙ্গে লুট করা হয়েছে।
বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাসুম মুটোফোনে জানান, তিনি হত্যার ঘটনায় নিন্দা, প্রকৃত হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি করেন। তিনি বলেন, একটি মহল ঘটনা ঘটানো এবং ইউনিয়নটি অশান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। যেটা বুঝতে পেরে তিনি প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এলাকায় শান্তি সভা করেছেন। তারপরও ছোট ছোট ঘটনা ঘটিয়ে বড় ঘটনার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনার দিনও পাল্টা আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরো জানান, ঘটনার পর এলাকার ৩৩ টি বাড়ি ভাংচুর হয়েছে। এখনও ৫ গ্রামের কমপক্ষে ৪ শ পরিবারে পুরুষ মানুষ গ্রামছাড়া। পুরুষশুন্য বাড়িগুলোতে নারীরা আছেন আতংকে। মিটার ভেঙ্গে দেওয়ায় প্রায় ৩০ টি পরিবার আছেন অন্ধকারে। ২৭ টি পরিবারের টিউবওয়েলের মাথা খুলে নেওয়া হয়েছে, যারা পানির কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় প্রায় ৪৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার ফরিদুজ্জামান ফরিদ বলেন, হত্যাকান্ডের পর কিছু ঘটনা ঘটেছে। আবার এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে পাশের ইউনিয়নের কিছু মানুষ লুটপাট করেছে। তিনি চেষ্টা করে এগুলো বন্ধ করেছেন, এখন এলাকা শান্ত। তিনি আরো জানান, সামাজিক দল করলেই একজন খারাপ হয় না, যে কারনে পালিয়ে যাওয়া অনেককে তিনি নিজে বাড়ি উঠিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, হত্যাকান্ড ঘটার পর কিছু ঘটনা ঘটেছে। তারা পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টা করে অনেকটা নিয়ন্ত্রন করেছেন। ভাংচুর ঠেকিয়েছেন, লুট হওয়া মালামালও উদ্ধার করেছেন। এলাকার বর্তমান পরিস্থিত ভালো, পুলিশ টহল আছে। তবে পুরুষ মানুষগুলো বাড়িছাড়া, নারীরা আতংকে থাকার বিষয়ে, এ জাতীয় তথ্য পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান

No comments

Powered by Blogger.