মৃত ব্যক্তির অপরাধে বাড়ির প্রবেশদ্বারে লেখা হলো ‘চোরাকারবারীর বাড়ি’, লজ্জায় বের হতে পারছেন না পরিবারের অন্য সদস্যরা


স্টাফ রিপোর্টার-

হতদরিদ্র কৃষক মেহেদী হাসান ওরফে সুমন (২২) গিয়েছিলেন ভাতর থেকে গরু আনতে। তিনি ছিলেন গরু ব্যবসায়ীদের শ্রমিক (জন), ভারত থেকে গরু এনে দিলেই পাবেন মোটা টাকা পারিশ্রমিক। চোরাকারবারীদের দেওয়া এমন প্রলোভনে গত বছরের ৮ নভেম্বর গরু আনতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারান সুমন। তিনদিন পর তার লাশ ফেরত পায় তার পরিবার।  

বাড়ির এক ছেলের এভাবে এই অকাল মৃত্যুর পর গোটা পরিবার যখন শোকাহত, ঠিক তখনই ওই পরিবারে নেমে এসেছে আরেক অমানবিক ঘটনা। গোটা পরিবারের সদস্যরা যা বয়ে চলেছেন মাসের পর মাস। বিজিবি’র পক্ষ থেকে সুমনের বাবা আব্দুল মান্নানের বাড়ির প্রবেশদ্বারে একটি গাছে সেটে দেওয়া হয়েছে এটি চোরাকারবারীর বাড়ি। ঘটনাটি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় গ্রামে। সুমনের দাফন শেষ হওয়ার পরদিন বিজিবি এটি সেটে দিয়েছেন, যা আজো বিদ্যমান।  

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, প্রথমে দেওয়া হয় গরু চোরাকারবারীর বাড়ি লেখা একটি বোর্ড, যা ঝড়ে নষ্ট হলে আবার দেওয়া হয়েছে চোরাকারবারীর বাড়ি। এই বোর্ডটিও তাদের পাহারা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বোর্ডটি কেউ সরিয়ে ফেললে বা কোনো ক্ষতি হলে গৃহকর্তাকেই জবাবদিহি করতে হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে লজ্জায় পাড়ায় বের হতে পারেন না পরিবারের সদস্যরা। রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারীরা দাড়িয়ে লেখাটি পড়েন আর নানা মন্তব্য করেন, যা তাদের ব্যাথিত করে। গৃহকর্তা আব্দুল মান্নান দুঃখ করে বলেন, মাঝে মধ্যে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু দরিদ্র হওয়ায় কোথাও যেতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। 

সরেজমিনে ভারত সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় গ্রামের ওই বাড়ি গিয়ে দেখা যায় বাড়ির প্রবেশদ্বারে একটি মেহগুনি গাছে একটি বোর্ড সাটানো রয়েছে। বোর্ডের উপরে একটি সাদা কাগজে লেখা আছে চোরাকারবারীর বাড়ি। যা লেমিনেটিং করে লাগানো হয়েছে। এই লেখাটির পেছনে আরেকটি লেখা ছিল, যা নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়ির কর্তা আব্দুল মান্নান জানান, দারিদ্রতার সঙ্গে তাদের বসবাস। নিজে দিনমজুরি কাজ করে সংসার চালান। নিজেদের চাষযোগ্য কোনো জমি নেই। ৫ শতক জমির উপর টিনের ২ টি ছাপড়া ঘরে বসবাস করেন। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলে কৃষি কাজ করতো। বড় ছেলে সুমন বিএসএফ এর গুলিতে মারা গেছে আর মেঝো ছেলে খালিদ হাসান ওরফে ইমন (১৯) এখনও কৃষি কাজের সঙ্গেই আছে। ছোট ছেলে জাহিদ হাসান (১১) পড়ালেখা করে। একমাত্র মেয়ে সুমি খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি বারা-মা, স্ত্রী, ছেলে, ছেলেদের স্ত্রী, সুমনের সন্তান মিলে বাড়িটিতে ১১ জন নিয়ে বসবাস করেন। বাড়িতে বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছে, আছে স্কুল-কলেজে পড়–য়া ছেলে-মেয়ে। যাদের সকলের মাথা নিচু করে দিচ্ছে বাড়ির প্রবেশদ্বারে থাকা এই বোর্ডটি।

আব্দুল মান্নান জানান, তার ছেলে সুমন ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতো। স্থানীয় গরুর ব্যবসায়ীরা তাকে মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়ে এলাকায় নিয়ে আসে। বাড়িতে আসার পর কয়েকদিন থেকে আবার ঢাকায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সুমন। ঘটনার দুইদিন পর ৯ নভেম্বর শনিবার তার ঢাকায় যাবার কথা। ৭ নভেম্বর বিকালে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে আর ফেরেনি। ৮ নভেম্বর সকালে বাড়িতে খবর আসে সুমন গরু আনতে ভারতে গিয়েছিল, পথে বিএসএফ এর গুলিতে মারা গেছে। এই খবর পেয়ে তারা কান্নাকাটি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ছেলের লাশ ফেরতের জন্য বিজিবি’র স্থানীয় লড়াইঢাটা ক্যাম্পে যোগাযোগ করেন। বিজিবি’র পক্ষ থেকে জানানো হয় লাশ ফেরতের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি সুমন কাদের সঙ্গে ভারতে গরু আনতে গিয়েছিল তা জানানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়। মান্নান আরো জানান, তিনদিন পর তিনি ছেলের লাশ পান। এরপর দাফন শেষ করেন। 

এদিকে সুমনের দাফন শেষে পরদিন খালিশপুর ৫৮ ব্যাটেলিয়ানের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু সদস্য তার বাড়িতে এসে পূর্বের দাবি অনুযায়ী সঠিক তালিকা না দেওয়ার অভিযোগে তার বাড়ির প্রবেশদ্বারে মাটিতে একটি বোর্ড গেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিজিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয় এই বোর্ডের কোনো ক্ষতি হলে গৃহকর্তা আব্দুল মান্নানই দায়ি থাকবেন। এই কথা জানার পর তারা মাটিতে নয় গাছে দেওয়ার দাবি করেন, যেন বাচ্চারা এটা নষ্ট না করতে পারেন। এভাবে তারা গাছে সেটে দিয়ে যান এটা গরু চোরাকারবারীর বাড়ি। আব্দুল মান্নান জানান, কিছুদিন পর সেই বোর্ডটি নষ্ট হয়ে গেলে এবার দিয়ে গেছে চোরাকারবারীরা বাড়ি। সেই থেকে তার বাড়ির প্রবেশদ্বারে মেহগুনি গাছে বোর্ডটি সাটা রয়েছে। 

মান্নানের স্ত্রী সাইফুন নেছা জানান, বিজিবি তাদের অপবাদ দিয়েছে তারা চোরাকারবারীর কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করেনি। এই অভিযোগে তাদের নানা ভাবে হয়রানীও করা হয়েছে। তিনি বলেন, ছেলে হারিয়ে যখন কান্নাকাটি করছি তখন বিজিবি তাদের উপর যে অমানবিক চাপাচাপ করেছে তা খুবই কষ্ট দিয়েছে। আর এখন তাদের গোটা পরিবারের সদস্যদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে কঠনি অপবাদ। 

ওই গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, তারাও এটা দেখে লজ্জা পান। এভাবে গোটা পরিবারকে অপবাদ দেওয়া ঠিন নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। স্থানীয় শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আমানুল্লাহ বলেন, বিষয়টি তাদেরও কষ্ট দেয়। কিন্তু বিজিবি’র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তারা বুঝতে চান না। তিনি এই বিষয়টির একটা সমাধান দাবি করেন। 

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ মিন্টু বলেন, এটা কোনো ভাবেই কেউ লিখতে পারেন না। আইনে আছে একজনের অপরাধ আরেকজন নেবে না, এ ক্ষেত্রে ওই পরিবারটি নিরাপরাধ। ফলে এটা আইনেও সমর্থন করে না, পাশাপাশি মানবাধিকারের চরম লংঘন। আর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ঝিনাইদহ সদর ইউনিটের সভাপতি আমিনুর রহমান জানান, এটা মানবাধিকার লংঘন। তার পরিবারের অন্য সদস্যদের অপরাধ না থাকলেও শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইস্টস্ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন এলিনা খান বলেন, চোরাকারবারীর শাস্তি হোক এটা তারাও চান। কিন্তু কারো বাড়ি এভাবে বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া যায় না। এটা মানবাধিকারের চরম লংঘন।        

বিষয়টি নিয়ে বিজিবি খালিশপুর ৫৮ ব্যাটেলিয়ান এর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল কামরুল আহসান জানান, সুমনের পরিবারের কাছে চোরাকারবারীদের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা দেয়নি, উল্টো চোরাকারবারীদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে চেপে গেছেন। তিনি আরো বলেন, সীমান্তে গরু আনতে গিয়ে কেউ মারা গেলে দেশের বদনাম হয়। এ ক্ষেত্রে একটি পরিবারের বদনামের চেয়ে কম গুরুত্বের নয়। অন্য কারো বাড়িতে এভাবে লাগানো হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে বলেন, তাদের ইচ্ছা আছে অর্থ বরাদ্ধ পেলে আরো লাগানো হবে।




No comments

Powered by Blogger.