জাফলং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিভোর
মারুফ আহমেদ-
তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে শবেমাত্র চতুর্থ বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে৷ প্রতিদিন দুই একটা করে ক্লাস হচ্ছে ৷ সুযোগটাকেই আমরা কাজে লাগিয়ে ছুটে চলি দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত সিলেট শহরে৷
৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ইং ৷ ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের ৪.৩০ টার ডাবল ডেকার বাসে করে কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হই ৷ মজমপুর থেকে শ্যামলী বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে বিকেল ৫ টায় ছেড়ে গেলেও আমাদের ৯ জনের জন্য আজ ৫.৩০ টায় ছাড়বে
৷ সবার কাছেই ২ টা করে ব্যাগ৷ কারও কাছে একটা ছোট - একটা বড়, কেউ আবার ছোট ব্যাগের পাশাপাশি আস্ত একটা লাগেজও নিয়েছে৷
৫ তারিখ সকাল ৮.৩০ টায় সিলেট শহরে পৌঁছালাম ৷ আগে থেকে সব কিছু প্লান করে রাখা মোতাবেক লোকাল বাসে করে রাওনা দিলাম মামার বাজারের উদ্দেশ্যে
। ১১ টার সময় জাফলং-এর মামার বাজারে পৌঁছাই ৷ নাজমুল হুজুর, যাকে আমরা একটি বিশেষ নামে ডেকে থাকি ৷
তার কথামতোই তার মামা আগে থেকেই সিলেটে আমাদের থাকার জন্য হোটেল, খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা এমনকি আমাদের সাথে করে বেশিরভাগ জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছেন।
সিলেট শহর থেকে মামার বাজারে যাওয়ার সময় দৃষ্টি কাড়ে লালাখাল ৷ যেটি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত৷ এটি অসংখ্য বাঁক বিশিষ্ট 'সারি' নদীর অংশ। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই নদী। জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রবাহমান পানির সাথে কাদা ও খনিজের পরিবর্তে বালুময় তলদেশের কারণেই এই নদীর পানি নীল। কথিত আছে, বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এই নদী দিয়েই বাংলাদেশে এসেছিলেন।
হোটেল পর্যটন থেকে দুপুর ২ টায় বের হই জাফলং-এর উদ্দেশ্যে। চার দিন পাঁচ রাতের সিলেট ভ্রমণের স্টার পয়েন্ট টা ছিলো জাফলং, যেটি সিলেটের গোয়ানঘাট উপজেলায় অবস্থিত। সিলেট শহর থেকে ৬২ কি.মি. উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই জাফলং। তাইতো সিলেট শহরে পৌঁছানোর সাথে সাথে বাসযোগে চলে যায় মামার বাজারে। আগে থেকেই বুক করা সেখানকার হোটেল পর্যটন-এ ব্যাগপত্র রেখে, ফ্রেশ হয়েই পায়ে হেটে মাত্র ১৫ মিনিটের ভেতর পৌঁছে যায় পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন এই জাফলং-এ, যা ভ্রমণপিপাসুদের পাহাড় আর পানি একই সাথে দেখিয়ে দৃষ্টি কেড়ে থাকে ৷
মুলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় এই জাফলং অবস্থিত। এর অপর পাশে রয়েছে ভারতের ডাওকি অঞ্চল। ডাওকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ঐসব পাহাড় থেকে ‘ডাওকি’
নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গন্ডশিলা (Boulder)। এ কারণেই জাফলং-এ প্রচুর পাথর পাওয়া যায়। এই এলাকার মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই পাথর উত্তোলন ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণকে ঘিরে।
জাফলং-এ দুই হাজারের কাছাকাছি খাসিয়া উপজাতি বাস করে থাকে। বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিলো খাসিয়া-জৈন্তা রাজার অধীনে। ১৯৫৪ সালে জমিদার প্রথার বিলুপ্তি হলে জাফলং-এর বিস্তীর্ণ এলাকা পতিত পড়ে ছিল। ব্যাবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে এসে পাথর পেয়ে নৌপথে পাথর উঠানো শুরু করে আর এভাবেই হয়ে উঠে আজকের এই জাফলং।
এখান থেকে ভারতের পাহাড় আর ঝর্ণা দেখা যায় যা পর্যটকের মন কাড়ে। ভারতের সর্পিলাকার ডাউকি নদী আর ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতু দু'চোখ ভর্তি ক্ষুধার্ত পিপাসু পর্যটকরের চোখ আর মোন ভরিয়ে দেয় তার নিজস্ব সৌন্দর্য্যে। এখানে আসবে আর ঝুলন্ত ব্রিজকে পেছনে নিয়ে নিজেকে ক্যামেরা বন্দি করবে না এটা ভাবাই যায় না। সবাই মিলে গ্রুপ ছবির পাশাপাশি সিঙ্গেল, ডাবল, ট্রিপল করে করে বিভিন্ন পোজে অসংখ্য ছবি তুলেও ফেলি আমরা। আমাদের ব্যাচের একমাত্র বিবাহিত, সুমন মামু ট্যুরে আমাদের সকল ছবি ক্যাপচার করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো।
ডাউকি নদীর পানির স্বচ্ছতা জাফলং-এর অন্যতম আকর্ষণ। পানির ভেতর দিয়েই স্পষ্ট স্বচ্ছ পাথর দেখতেই ভালো লাগে। অনেকে আবার তা ক্যামেরা বন্দীও করে রাখে। বর্ষাকাল আর শীতকালে জাফলং আলাদা আলাদা সৌন্দর্যে ফুটে উঠে। আমরা শীতকালের সৌন্দর্য টাই দেখেছি। এখানে পাম, নারকেল আর সুপারি গাছ দেখা যায়। জাফলং জিরো পয়েন্টে রয়েছে তামাবিল স্থল বন্দর। এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হয়।
নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অধিক মাত্রায় পাথর তোলায় জাফলং তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে আর জীববৈচিত্র ও প্রণীবৈচিত্র হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
৬ ডিসেম্বর ২০১৯, শুক্রবার। সকাল ৭:৩০ টায় রেডি হয়ে বের হয় বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে ৷ মামার বাজার থেকে মিনা বাজার পর্যন্ত সি.এন.জি তে যাই । তারপর গুগল ম্যাপের সাহায্যে পায়ে হেঁটেই বাকি পথটুকু যাই । মাঝে একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অনেক পথ হাঁটা লাগে ।
সিলেট শহর থেকে ৪০ কি.মি. অদূরে গোয়ানঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিছানাকান্দি। এটি মূলত পাথর কোয়েরি, কারণ নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়। এই জায়গায় খাসিয়া পর্বতের বিভিন্ন স্তর এসে একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। খাসিয়া পর্বত থেকে নেমে আসা একটি ঝর্ণা থেকেই এই হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে যা পিয়াইন নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে। শিলা পাথরগুলো প্রাকৃতিক এবং পাহাড়ি ঢলের সাথে পানির মাধ্যমে নেমে আসে। বর্ষাকালের এটি পানিতে ভরপুর থাকে,তখন যাতায়াত করতে হয় নৌকায়, আমরা শীতকালে যাওয়ায় নৌকা ভ্রমণ সম্ভব হয় নাই। তাই সেখানকার ভাসমান হোটেলটিকেও শুকনো বালুর উপরই দেখতে হয়েছে, তবে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে ভারতের পাহাড়ের সাথে ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। হাঁটু পানিতে অনেকে গোসলও করেছে ৷ পাশেই অবস্থিত মার্কেট, যেখানে ভারতের অনেক পণ্য খুব কম দামেই পাওয়া যায় ৷ সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত ৷
মোটর সাইকেলে চড়ে মিনা বাজারে আসার পর জুম্মার নামাজ পড়লাম ৷ নামাজ শেষে সেখানকার এক হোটেলেই দুপুরের খাওয়াটা শেষ করি ৷ রাতারগুলে যাবার ইচ্ছা থাকলেও সময় সল্পতার কারণে পূর্ব নির্ধারিত সেই প্লান চেঞ্জ করে পান্থুমাই ঝর্ণা দেখে খাসিয়া পল্লীর বাজার পর্যন্ত মোটর সাইকেল করে চলে আসি সবাই ৷
খাসিয়া পল্লী বাজারের পাশেই জেগে উঠেছে এক বিশাল চর ৷ আর সেখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি যা জাফলং-এর সৌন্দর্য নষ্ট করছে, তাইতো সেসব বসতি উচ্ছেদের অভিযান চালাচ্ছিলো বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ ৷ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়স্থ ইবি থানায় দীর্ঘদিন কর্মরত ওসি রতন শেখের সাথে সেখানেই দেখা। নিজ থেকেই আমাদের ডেকে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়, পুরো আড্ডা জুড়েই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের থানায় কাটানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন তিনি ৷
রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় রওনা হলাম তামাবিল স্থল বন্দরের উদ্দেশ্যে ৷ বাসে করে গেলেও দীর্ঘ জ্যামের কারণে পায়ে হেঁটেই রুমে ফিরতে হল ৷
হোটেল পর্যটনে দুই রাত কাটানোর পর ৭ তারিখ সকালে বাসযোগে সিলেট শহরে চলে যায় ৷ ওসমানী জাদুঘরের বিপরীতে অবস্থিত হোটেল আল আসমাতে উঠার পর ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেবার পর সি.এন.জি ভাড়া করে চলে যাই বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান 'মালনীছড়া চা বাগান' - এ। সেখানে চা বাগান দেখার পাশাপাশি চা'য়ের পাতা ছিড়ে নিয়ে আসি৷ পাহাড়ের উপর অবস্থিত রাবার বাগান থেকে রাবারের আঠা সংগ্রহ করার পদ্ধতিও দেখি ৷
মালনীছড়া থেকে আমরা সোজা হযরত শাহজালালের মাজারে চলে গেলাম । পুরো মাজার ঘুরে দেখার পর, মাজারের বাইরে অবস্থিত দীর্ঘ মার্কেট থেকে সকলেই কম বেশি কেনাকাটা করি।
৭ ডিসেম্বর, বেশ সকালেই হোটেল ছেড়ে ব্যাগ পত্র নিয়ে চলে গেলাম কদমতলা বাস স্ট্যান্ডে, সেখানে নাস্তা করে প্রথমে বাসে তারপর সি.এন.জি ভাড়া করে চলে গেলাম সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহত্তম জলপ্রপাত, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে। পথিমধ্যে চোখে পড়ে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি 'হাকালুকি হাওর' যেটি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা
(৪০%), কুলাউড়া
(৩০%) সহ আরও তিনটি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত অবলোকন শেষে সি.এন.জি ও ট্রেন করে চলে যায় শ্রীমঙ্গলে, ট্রেনের ভেতর থেকেই দুই পাশে অবস্থিত চা বাগান দৃষ্টি কাড়ে
। সন্ধ্যার পর শ্রীমঙ্গলে পৌঁছানোয় চা বাগানের ভেতর যাওয়া সম্ভব হয় নাই ৷ সেখানে অবস্থিত চা বাজার থেকে হরেক রকমের চা'পাতি কেনার পর বাসযোগে চলে যায় শায়েস্তাগঞ্জ। সিলেট শহর থেকে টিকেট কাটলেও এই শায়েস্তাগঞ্জ থেকেই রাত ১১:৩০ টায় বাসে উঠে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই ৷ এই
৫ দিনের স্মৃতিটা ভুলবার নয় ৷
মারুফ আহমেদ
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৷
No comments