নতুন আতংকে কালীগঞ্জের চাষীরা, ৪ মাসে ২১ কৃষকের ক্ষতি

শাহ আলম,কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) ॥ 

উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর আতংকে দিন কাটছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের চাষীদের। প্রতিদিনিই যেন এক অজানা আতংক বিরাজ করছে তাদের মাঝে। রাত পোহালেই না জানি কোন ফসল তছরুপ করে দুর্বৃত্তরা। একের পর এক ফসল তছরুপে মরিয়া হয়ে উঠেছে ফসলের শত্রুরা। কোনভাবেই এর প্রতিকার মিলছে না। পুলিশ প্রশাসনও তাদের আটক করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিনই থানায় লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন ভুক্তভোগী চাষীরা। কিন্তু আসলেই কি প্রতিকার মিলছে? প্রশ্ন চাষীদের। গত চার মাসে প্রায় ২১ কৃষকের ফসল কেটে সাবাড় করেছে দুর্বৃত্তরা।

এদিকে কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না এই ফসল সন্ত্রাসদের। প্রতিদিনই যেন শ্রেণীশত্রু খতমের ন্যায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ফসলের ক্ষতি করতে মাঠে নেমেছে এদল। তবে প্রশাসন বলছে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোষ্টিগত বিরোধের জেরে এমনটি হয়ে থাকে। এসকল অপরাধীদের ফৌজদারী আইনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে পুলিশ।  

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাস ধরে শত্রুতা করে মানুষের অগোচরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকের সবজি ক্ষেত কেটে সাবাড় করছে। পুকুরে কখনও কীটনাশক দিয়ে আবার গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ নিধন করছে। কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করলেও সমাজের গুটি কয়েক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দ্বারা স্বপ্ন ভাঙছে তাদের। তারা বলছেন, শত্রুতার মাধ্যমে কৃষকের ভরা ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে। এটা মনুষ্যত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০ জুন বাবরা গ্রামের আলী বকসের ২ ছেলে কৃষক টিপু সুলতান ও শহিদুল ইসলামের দুই ভায়ের ১৫ কাঠা জমির কাঁদিওয়ালা কলাগাছ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। একইভাবে ৩ জুলাই মল্লিকপুর গ্রামের মল্লিক মন্ডলের ছেলে সবজি চাষী মাজেদুল মন্ডলের বেথুলী মাঠের আড়াই বিঘা জমির ৩ শতাধিক ধরন্ত পেপে গাছ কেটে দেয়। এর ঠিক ৪ দিন পরে ৭ জুলাই পৌর এলাকার ফয়লা গ্রামের তাকের হোসেনের ছেলে আবু সাঈদের ১৫ শতক জমির ধরন্ত করলা ক্ষেত কেটে দেয়। ১৩ জুলাই বারোবাজারের ঘোপ গ্রামের মাহতাব মুন্সির ছেলে আব্দুর রশিদের দেড় বিঘা জমির সিমগাছে কীটনাশক স্প্রে করে পুড়িয়ে দেয়। ৯ আগষ্ট তিল্লা গ্রামের সতীশ বিশ্বাসের ছেলে কৃষক বিকাশ বিশ্বাসের ১৫ শতক ধরন্ত করলা ক্ষেত কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২৮ আগষ্ট সাইটবাড়িয়া গ্রামের মাছচাষী ইউপি সদস্য কবিরুল ইসলাম নান্নুর পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে। একই তারিখে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার খামারাইল গ্রামে মাছচাষী মমরেজ আলীর ৮ বিঘার পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে মাছ নিধন করে দুর্বৃত্তরা। এর ৩ দিন পর ৩১ আগষ্ট একই ইউনিয়নের রাড়িপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্যের ৪৮ শতক মুল্যবান দার্জিলিং লেবু ও থাই পেয়ারার কলম কেটে দেয় দূর্বৃত্তরা। এর আগে ২৫ আগষ্ট বলরামপুর গ্রামের মাছচাষী মমরেজ আলীর পুকুরে একইভাবে বিষ দিয়ে প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দেয়। ৬ সেপ্টেম্বর সাইটবাড়িয়া গ্রামের আনছার আলী মোল্যার ছেলে হতদরিদ্র কৃষক বাপ্পি মোল্যার ৯ শতক ধরন্ত বেগুন ক্ষেত কেটে দিয়ে সর্বশান্ত করে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার খয়েরতলা গ্রামের রফি বিশ্বাসের পুকুরে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে দুর্বৃত্তরা। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে পৌর এলাকার চাপালী গ্রামে মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে আতিয়ার রহমানের প্রায় ১ বিঘা জমির লাউ গাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ১০ অক্টোবর ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধের জের ধরে কালীগঞ্জ উপজেলার দুধরাজপুর গ্রামে লিংকন বিশ^াসের শতাধিক ধরন্ত লাউগাছ কেটে সাবাড় করা হয়।  একই তারিখে উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে বিশারত মন্ডলের ক্ষেতে ফুলকপির বীজতলার চারা কেটে কে বা কারা। ১১ অক্টোবর রাতে উপজেলার বড় শিমলা গ্রামে নূর ইসলামের ২৩ শতক জমির ধরন্ত লাউ গাছ কেটে দেওয়া হয়। ১৩ অক্টোবর উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে বাপ্পি হোসেন নামে এক কৃষকের ১৪ কাঠা জমির পুইশাক কেটে ফসলের ক্ষতি করা হয়। ১৪ অক্টোবর সদর উপজেলার বিজয়পুর গ্রামে মকিদুল ইসলামের প্রায় ১ বিঘা জমির ধরন্ত কলাগাছ কেটে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামে আলম হোসেন নামে এক কৃষকের ২৬ শতক জমির ধরন্ত লাউগাছ কেটে সাবাড় করেছে দুর্বৃত্তরা।  

ক্ষতিগ্রস্থ মাছ চাষী সাইটবাড়িয়া গ্রামের কবিরুল ইসলাম নান্নু জানান, ধারদেনার মাধ্যমে মাছ চাষ করেছিলাম। পুকুরের মাছও বেশ বড় হয়েছিল। কিন্ত রাতের আধারে কে বা কারা পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দিয়েছে। সকালে পুকুর থেকে মরা মাছ তোলার সময় গ্যাস বড়ি পেয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমি কারও শত্রু হতে পারি। অথবা আমার কোন অপরাধ থাকতে পারে কিন্ত পুকুরের মাছগুলো কি অপরাধ করেছে ?। তাছাড়াও একজনের ক্ষতি করে তাদেরই বা কি লাভ ?। এখন কোন ভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছিনা। নান্নু আরও জানান, রাতের আধারে কে বা কারা মাছ নিধন করেছে। আমি কাউকে দেখিনি ফলে শুধু থানায় একটি সাধারন ডাইয়েরী করেছি। 

এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার ওসি মুহাঃ মাহাফুজুর রহমান মিয়া জানান, কৃষকের ভরা ক্ষেত কেটে দেয়ার মত ক্ষতি পুশিয়ে উঠার নয়। সম্প্রতি এমন ঘটনার কথা শুনছি। কিন্ত দুষ্টু প্রকৃতির এ মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থরা সন্দেহ করলেও তা অনুমান নির্ভর হওয়ায় কেউ অভিযোগ দিতে চাচ্ছেন না। বিগত ৩/৪ মাসে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ফসলহানী ঘটলেও মাত্র ৩ জন থানায় সাধারন ডায়েরী করেছেন। তারাও বলতে পারছেন না কারা এমন জঘন্য কাজ করছে। ফলে এক ধরনের জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। তারপরও পুলিশ সামাজিক ও গোষ্টিগত বিরোধ, সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে এটা হতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারনা করছে। তবে এটা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কোন বিশেষ মহল করছে কিনা সেটাও উড়িয়ে না দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।


No comments

Powered by Blogger.