'সুখের সন্ধানে'- ৫ম পর্ব
আলহাজ্ব এম. এ. কাদের
(সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)
সুখী হতে হলে টেনশন মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। আর টেনশন মুক্ত থাকতে হলে অবশ্যই বিরক্তি, রাগারাগি ও উত্তেজিত হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। নবী করীম (সঃ) কে মানুষ অত্যাচার, নির্যাতন, রক্তাক্ত করে মক্কা থেকে বিতাড়িত পর্যন্ত করেছিল, কিন্তু তিনি কখনো রাগারাগি-গালাগালি করেননি। তিনি কাউকে অভিসম্পাত পর্যন্ত করেন নি। অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যকে সহজে বদলানো যায়না, নিজেকে বদলাতে হয়। মানুষ যখন রেগে যায়, উত্তেজিত হয়ে যায়, ক্ষেপে যায় তখন মানুষের বিবেক বোধ লোপ পায়। ওই মুহুর্তে মানুষ যা করে তা ভুল করে, যে সিদ্ধান্ত নেয় সে সিদ্ধান্ত ভুল হয়। শ্রেষ্ঠ, সফল মানুষ যাঁরা, তাঁরা কখনোই রাগ করেননি, কারণ তাঁরা ভুল কাজ করতে চান না, ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চান না। এ কারণেই শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো সব সময় সুখী ছিলেন। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, সেই বড় যোদ্ধা যে রাগের সময় রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে তো নিয়ন্ত্রণহীন, ভারসাম্যহীন-অস্বাভাবিক মানুষ। সব সময় খারাপ চিন্তা, খারাপ অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ত্যাগ করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, কেউ ভালো মানুষ হয়ে জন্মায় না, নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে ভালো মানুষ হতে হয়। ওপরে ওঠা কঠিন কিন্তু নিচে নামা সহজ, আর এই কারণেই মনোবিজ্ঞান বলে, “Good habits are hard to develop but easy to live with; bad habits are easy to develop but hard to live with.” অর্থাৎ, ভালো অভ্যাস অর্জন করা কঠিন কিন্তু জীবন হয় সুন্দর ও সুখের ; খারাপ অভ্যাস অর্জন করা সহজ কিন্তু জীবন হয় কঠিন ও অ-সুখের। সুতরাং জীবনকে সুখময়, আনন্দময়, জনপ্রিয় করতে চাইলে অবশ্যই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। আল্লাহ্ বলেন, ভালো এবং মন্দ কাজ এক হতে পারে না। তোমরা মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিরোধ করো। এতে তোমার শত্রু বন্ধুতে পরিণত হবে (সূরা হামিম আস সাজদা, আয়াত ৩৪)। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, তোমার সাথে কেউ ভাল ব্যবহার করুক বা খারাপ ব্যবহার করুক তুমি সব সময় তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?” মাদার তেরেসা বলেছেন, “তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালবাসতে না পারো, অদৃশ্য স্রষ্টাকে ভালবাসবে কীভাবে”? জীবনে সফলতার শক্তি রাগ তৈরি করা না। বরং রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে টেনশন মুক্ত থাকা। আনন্দহীন, উচ্ছ্বাসহীন, মানসিক চাপ মন ও শরীরের ওপর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া করে, ফলে ক্ষতিকারক বিভিন্ন স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ হয়। যার ফলে এড্রেনালিন, ডোপামিন, কর্টিসল আমাদের শরীরের বায়োকেমিক্যাল মেটাবলিক পদ্ধতিকে হেস্তনেস্ত করে দেয়। এতে করে রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্ত জমাট বাঁধে এবং রক্ত নালীতে ব্লকের সৃষ্টি হয়। এতে হৃদরোগ, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পেটের আলচার, আলসার, ক্যান্সারসহ ক্রনিক রোগসমূহ সৃষ্টির সবগুলো পথ প্রশস্ত হতে থাকে। এক কথায় এটা শরীরের গঠন, গাঁথুনি কে নড়বড়ে করে ফেলে। কাজেই আনন্দহীন মানসিক চাপ থেকে নিজেকে অবশ্যই রক্ষা করে দুঃখ পরিহার করে সুখ সৃষ্টি করতে হবে। খুশিতে সুখ আছে। মনোগবেষকরা বলেন, Happiness is my choice. অর্থাৎ সুখ আমার ইচ্ছা। আমি যখন ইচ্ছা করি, আমি সুখ অনুভব করতে পারি। আপনার প্রথম দায়িত্ব নিজেকে খুশি রাখা। নিজের মনের ভিতর খুশি না থাকলে আপনি সুখী হবেন কীভাবে? প্রতিটি মানুষ যদি খুশি থাকে তবে পৃথিবী হবে সুখের স্বর্গ। মানুষ এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা, এত গবেষণা কেন করে? সুখ, শান্তি ও খুশির জন্য। এটি অনুভবের বিষয়, এটি অনুভব করতে হয়। খুশি চাওয়ার বিষয় নয়, খুশি থাকার বিষয়। এটি মানসিক বিষয় অথচ আমরা এটা বাইরে খুঁজে ফিরি। এটা হলে খুশি হব, ওটা পেলে খুশি হব এভাবে আমরা অন্যের মধ্যেও খুশিকে চাপিয়ে দিয়েছি। অন্যের ওপর আপনার খুশি নির্ভর করে না, আপনার খুশি নির্ভর করে আপনার ওপর। খুশি, সুখ হলো আপনার নিজস্ব ভাবনা।
বিখ্যাত লেখক Paul H. Dann এর মতে, “Happiness is a journey, not a destination.” খুশি লক্ষ্যবস্তুতে নয়, যাত্রার শুরুতেই খুশি প্রাপ্তির ভাবনা কঠিন হবে কিন্তু মনকে খুশি রাখতে পারলেই গন্তব্যে পৌছানো সহজ হবে। কারণ মনে খুশির উদ্দীপনা থাকলে পজিটিভ হরমোন অক্সিটোসিন, এন্ডোরফিন্স নিঃসরণ হবে, ফলে কঠিন কাজ সহজ হবে। আপনার সকল কাজ যখন সুন্দর ভাবে সমাধান হবে তখন আপনি ভালো মুডে থাকবেন, খুশিতে থাকবেন, সুখে থাকবেন। কে কি বলবে, কে কি করবে, সেটা অন্যের হাতে কিন্তু আপনি কি করবেন সেটি তো আপনার হাতেই। সুতরাং কোন ঘটনায় আপনি বিমর্ষ হবেন, রাগ করবেন নাকি মুচকি হাসবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার ভাবনা বা দৃষ্টি ভঙ্গির ওপর। মানুষের জীবনে ভাল সময় বা খারাপ সময় আসবেই। জীবন মানেই যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়-পরাজয় থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে। সুতরাং হতাশা নয়, আশা-আকাঙ্খা, হাসি-খুশি এবং সুখই কাম্য। সুখের জন্য খুশিতে থাকার প্র্যাকটিস গুরুত্বপুর্ণ। প্রতিটি মানুষের ভিতরে খুশি থাকে ভরপুর। প্র্যাকটিস করলেই পানির জোয়ারের মতো খুশির জোয়ার বইবে সারাক্ষণ। আর খুশিতে আসবে সুখ। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, একবার চিন্তায় আর একবার বাস্তবে। মানুষ যা কিছু করে তা আগে থেকে চিন্তা-ভাবনা করেই করে। চিন্তা যেমন হবে কাজ তেমনই হবে। একটি কাজ বার বার করলে তা অভ্যাসে পরিনত হয়। অভ্যাসের সমষ্টি তার চরিত্র এবং এই চরিত্রই তাকে নিয়ে যাবে গন্তব্যে। অর্থাৎ একজন মানুষের গন্তব্য সুখের জায়গায় হবে, না দুঃখের জায়গায় হবে, তা নির্ভর করে তার চরিত্রের উপর। চরিত্র নির্ভর করে তার অভ্যাসের উপর আর অভ্যাস নির্ভর করে তার কর্মের উপর। কর্ম নির্ভর করে চিন্তার ওপর সুতরাং চিন্তা যেমন হবে বাকি সমস্ত কাজ তেমন হবে। জীবনকে সুখ শান্তিময় করতে Positive thinking দরকার। যে কোন অবস্থায় বা যে কোন পরিস্থিতিতে সঠিক চিন্তা করতে পারা কে পজিটিভ থিংকিং বলে। পজিটিভ থিংকিং এ সব কিছু যে আমার পক্ষে আসবে সব সময় আমার জয় হবে এমনটি নয়। কোন কোন সময় অনিবার্য বিষয়টি সহজ ভাবে মেনে নিতে হবে, পরিস্থিতিটাকে গ্রহণ করতে হবে, সেটা আমার পক্ষে যাক বা নাই যাক।(চলবে)
Email: makader958@gmail.com
Phone: 01711-338182, 01916-604161
Facebook page: facebook.com/makader1958
No comments