শহীদ গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদহে ঘাতকরা কোথায় নিয়ে হত্যা করেছে তা আজো পরিবারের কাছে অজানা

চিত্রা নিউজ ডেস্ক-

প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে জনহিতৈষী গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদ বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে গিয়েছিলেন গোসল করতে। প্রায় সকলের হাতেই দাঁত পরিষ্কার করা পাউডার আর দাতুনী। কেউ কেউ পানিতে নেমেছেন, আবার কেউ পুকুর পাড়ে বসে দাঁত পরিষ্কার করছেন। এমনই এক সময় স্থানীয় কিছু রাজাকার সঙ্গে নিয়ে পাকিস্থানী ঘাতক সেনারা বাড়ি ও বাড়ির পারিপাশ ঘিরে ফেলে। ভয়ে কেউ কেউ পালিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কেউ গাছের ডালে উঠে পড়েন। ঘাতকরা পরিবারের বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদকে তুলে নিয়ে যান। ঘটনাটি ছিল ১৯৭১ সালের মে মাসের কোনো এক রবিবার। 

গোলাম মহিউদ্দীনের ভাতিজা বোরহান উদ্দীন আহম্মেদ ঘটনার দিনটি কত তারিখ ছিল তা বলতে না পারলেও এটা বলেন ঘটনার সময় তিনিও পুকুর পাড়ে ছিলেন। পাকিস্থানী সেনাদের দেখে তিনি একটি গাছের ডালে উঠে লুকিয়েছিলেন। তিনি বলেন ঘটনার সময় তার বয়স তখন ১৬/১৭ বছর। আর তার চাচা তার চেয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের বড় ছিলেন। তিনি ঠিকাদারী পেশায় যুক্ত ছিলেন। তাদের পরিবারটি ছিল আওয়ামীলীগের আদর্শের পরিবার। কেউ কেউ সক্রিয় রাজনীতি করলেও গোলাম মহিউদ্দীন ঠিকাদারীর পাশাপাশি এলাকার মানুষের কল্যানে কাজ করতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করা সহ নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া তাদের পরিবারে ৫ জন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। যে কারনে ঘাতকরা তার চাচাকে ধরে নিয়ে যায়। আজো তারা চাচার মৃতদের খুজে পাননি, এমনকি কোথায় নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটাও জানেন না। তিনি আরো জানান, ওই চাচা গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদের এক পুত্র রেজাউল ইসলাম সম্মূখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে ঘাতকের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। 

গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদ ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার ভায়না গ্রাম এক সম্ভ্রন্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম মরহুম বদরুদ্দীন আহম্মেদ। তারা ছিলেন ৫ ভাই, গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদ ছিলেন সবার বড়। এরপরের ভাই মোঃ মনিরুজ্জামান ব্যারিস্টারী পড়তে বিলেত যাবার পূর্বে মারা যান। তৃতীয়জন ডাক্তার রফি উদ্দীন আহম্মেদ নিজ বাড়িতেই চেম্বার খুলে এলাকার মানুষের চিকিৎসা দিতেন। তিনি গ্রামের মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে মেডিকেলে পড়ালেখা করেও বাইরে চাকুরী করতে যাননি। গ্রামের মানুষের অনেকটা ফ্রি চিকিৎসা দিতেন। এরপরের ভাই মোশারফ আলী আহম্মেদ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। সবার ছোট ভাই আশরাফুল আবেদীন জাতীয় পার্টির সময়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। 

গোলাম মহিউদÍীন আহম্মেদের ৫ সন্তান, যাদের মধ্যে বর্তমানে ২ জন বেঁচে আছেন। তারা ব্যবসা-বানিজ্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তবে এই পরিবারের কেউই আর এখন ভায়না গ্রামে থাকেন না। কেউ কেউ ঝিনাইদহ শহরে আবার কেউ ঢাকায় বসবাস করেন। শুক্রবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ভায়না বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এরা কেউ গ্রামে থাকেন না। গোটা পরিবারের কাউকে পাওয়া যাবে না। তিনি মহিউদ্দীন আহম্মেদের পরিত্যক্ত বাড়ি দেখিয়ে বলেন এই যে বাড়িটা দেখছেন এটাও সেই সময়ে গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার ছিলেন তারা। তাদরে ভায়েরা সবাই গ্রামের মানুষের নানা কল্যানে কাজ করে গেছেন। তাদের পরিবারে একাধিক সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে চলে যান। যে কারনে পাকিস্থানীরা পরিবারটির উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিল। গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, সেই সময়ের গল্প এবং গোলাম মহিউদ্দীন আহম্মেদের সম্পর্কে জানতে হলে ঝিনাইদহ শহরে বসবাসরত তারই ভাতিজা বোরহান উদ্দীন আহম্মেদ এর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। 

শহরে এসে বোরহান উদ্দীনের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, তার চাচা মহিউদ্দীনকে যেদিন তুলে নিয়ে যান সেই সময়ের দৃশ্যটি এখনও চোখের সামনে ভেষে উঠে। পাকিস্থানী সেনাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের চেহারা কোনো ভাবেই ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না গানপাউডার দিয়ে গোটা বাড়ি জ¦ালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য। এমনকি চাচার লাশটিও তারা ফেরত পাননি, শুনেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালী নামক স্থানে নিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। এই লাশ না পাওয়ার কষ্ট তারা আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানান। 


No comments

Powered by Blogger.