কেন আমরা রোজা রাখি

  

 আমিনুর রহমান টুকু   

কেন আমরা রোজা রাখি, আল্লাহ বলছেন - যেন আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। তাকওয়ার সাধারণ অর্থ করা হয়, আল্লাহ ভীতি হিসাবে। তাকওয়া শব্দ এসেছে ‘ওকওয়া’ শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো সুরক্ষা। শেষ বিচারের দিন সকলেই নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইবে। আল্লাহ বলবেন, সেদিন তোমরা কিরুপে আত্মরক্ষা করবে, যদি তোমরা সেদিনকে অস্বীকার করো। যেদিন বালককে করে দিবে বৃদ্ধ। তাই আল্লাহ ‘তাত্তাকুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যাতে আমরা নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারি, এটা বুঝাতে। এটা হচ্ছে তাকওয়ার আসল অর্থ। আল্লাহ বলছেন, আমি তোমাদেরকে রোজার বিধান দিয়েছি এই কারনে যে, যাতে তোমরা নিজেকে বাঁচাতে পারো, এটা বুঝাতে। মানে কি এটার, আসুন বুঝার চেষ্টা করি। 

আল্লাহ কুরআনে বলছেন, প্রথম রমজান শব্দ শুনলেই আপনার যে জিনিসটা চিন্তা করার কথা ছিল, তা হলো “শাহরু রমাদান, আল্লাজি উনজিলা ফিহিল কুরআন”। আল্লাহ এটা বলেন নি যে, তিনি রোজা ফরজ করেছেন। বলেছেন, রমজান সেই মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছিল। যে কারনে রমজান একটি বিশেষ মাস, তা রোজা নয়। কেন বিশেষ মাস, রমজান বিশেষ মাস এজন্য যে, এ মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহ এটিই আমাদের বলছেন। মুসলিমরা যেন ভুলে না যায়, রমজান কুরআনের মাস, আশ্চর্য কিতাবের মাস। রমজানের সময় আপনাকে কুরআন পড়তেই হবে। শয়তানের বিরুদ্ধে আপনার আসল অস্ত্র হবে কুরআন।

যখন রমজানের কথা আপনার মাথায় আসে তখন আপনি কি ভাবেন, তা হলো রোজা রাখা। আর কোন্ জিনিষটা মানুষ চিন্তা করে, ইফতার, ছোলা, মুড়ি, ফল, সরবত কত ধরনের ইফতার আছে ইত্যাদি। আপনি যদি খাবারের কথা চিন্তা নাও করেন, আপনি বলেন ভাই এবছর রমজান গরমের সময়, কি যে হবে, এবারের রোজা কঠিন হবে। আপনার মাথায় শুধু এই ধরনের চিন্তাই আসে। এটাই আমাদের নিয়ম।

আপনি যদি কোন কিছু ভালভাবে করতে চান, তাহলে আপনাকে সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বিশেষত শারীরিক প্রশিক্ষণ। যেমন ধরুন কেউ সৈনিক হতে চান বা পুলিশ অফিসার হতে চান। প্রশিক্ষণ আপনাকে শেখায় কিভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকতে হয়। প্রশিক্ষনের প্রথম দিকটা কঠিন থাকে। তারপর এটা শরীরের সাথে অভ্যস্থ হতে শুরু করে। প্রশিক্ষনের অনুশিলনগুলো তুলনামুলক সোজা হয়। যেমন ধরুন কোন অগ্নি নির্বাপক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা আগুন ধরায় ঠিকই, কিভাবে আগুনটাকে নিভাতে হবে সেটা জানার জন্য। তখন আগুন থাকে নিয়ন্ত্রিত। আসল পরিস্থিতির মত নয়। তারা হয়তো বিল্ডিং এর উপর থেকে লাফ দিতে বলবে। কিন্তু আসল পরিস্থিতি এটা নয়। এটা বাস্তবের মত নয়।  

রোজা রাখা অবস্থায় আপনি প্রতিনিয়ত ক্ষুধা অনুভব করেন। এমন একটি সময় যায়না যে, আপনি ক্ষুধা অনুভব করেন না। আপনি পছন্দ করেন বা না করেন, আপনার গলা আপনার সাথে যুদ্ধ শুরু করে, আপনার কন্ঠনালি আপনার কাছে চিৎকার করে, পানি পানি বলে। যখন আপনার কন্ঠনালি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে, আপনি আপনার গলাকে ধমক দিয়ে বলেন, এই চুপ করো, এখনও মাগরেবের সময় হয়নি। আপনার পেট আপনার সাথে কথা বলে, অনেক সময় জোরেই কথা বলে, এই কি হচ্ছে, উপরে খাদ্যের যোগান বন্ধ কেন। আপনি বলেন, এই এখন কেবল সকাল, আর এখন তুমি চিৎকার শুরু করে দিলে। এরকম প্রয়োজনীয়  সবকিছুই অপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আপনি নিজেই নিজের সাথে কথা বলা শুরু করেন। 

আপনি যখন রোজা রাখেন, আপনার ভেতরে একটি শরীরবৃত্তিক যুদ্ধ হয়। আপনার গলা আপনার বিরুদ্ধে থাকে, আপনার পেট আপনার বিরুদ্ধে থাকে, আপনার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং আপনার কাছে মিনতি করে, দয়া করে আল্লাহর অবাধ্য হও। এসব আকাঙ্খাগুলো আপনার শরীরের। আপনি রোজা করেন সরাদিন আপনার শরীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আপনি বলেন, না না আমি আমার অন্তর আল্লার কাছে সমর্পণ করেছি। তাই আমার শরীর যদি কিছু চায়ও আমি তাকে দিবনা। 

যখন আপনি রোজা রাখেন, আপনি আপনার অন্তরকে আপনার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রশিক্ষণ দেন, আপনি এটাই করেন। কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ, এটার মূল উদ্দেশ্য কি। যখন রোজা শেষ হয়ে যাবে আপনার অন্তর আপনার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি হবার কথা। তাই আপনি যেটা ইচ্ছা সেটা খাবেন না, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবেন না, যেদিকে ইচ্ছা সে দিকে তাকাবেন না। কিন্তু আপনি যখন রোজা রাখেন তখন কি হয়, আপনার শরীর দুর্বল হয় আর আপনার অন্তর শক্ত হয়। অন্তর হচ্ছে তাকওয়ার বাসস্থান। আপনি যখন শরীরকে দুর্বল করছেন তখন অন্তরকে শক্ত করছেন। আপনি নিজেকে বিভিন্ন কাজ থেকে বিরত রাখতে শিখছেন। 

আপনি রোজা রাখছেন কিন্তু কুরআন পড়ছেন না। পুরো ত্রিশ দিনে এক পাতা কুরআন পড়ছেন না, এমন কি আধা পাতাও নয়, দু’টি আয়াতও নয়। আপনি কুরআন থেকে কিছুই মুখস্ত করেননি। তাহলে আপনি কি করে বুঝবেন যে, আল্লাহ আমাদের কি বলছেন। রমজানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কুরআন নাজিল হওয়াটা উদযাপন করা। আপনি যখন কুরআন পড়েন তখন আল্লাহর সাথে কথা বলেন। 

একটা জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান। কুরআন মুসলিমদের সংবিধান। আল্লাহ এও বলছেন, কুরআন শুধু মুসলিমদের জন্য নয়। তিনি বলছেন “হুদাললিন নাছ” এটা সকল মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক। তিনি বলেননি হুদাললিন আরব, শুধু আরবদের জন্য,  হুদাললিন বণি ইসরাইল, শুধু বণি ইসরাইলদের জন্য। এটা মদিনার ইহুদিদের জন্যও। মুসলিমরা যেন ভুলে না যায় এটা কুরআনের মাস। মহাবিশে^র মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বোত্তম উপহার, দয়া। মানব জাতীর জন্য জীবন বিধান, সিলেবাস, কারিকুলাম যেটাই বলেন। রমজানে আমাদের কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

রমজান আমাদের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। রোজা আপনাকে বিভিন্ন কাজ থেকে বিরত থাকতে শেখায়, অর্থাৎ নফ্সের গোলামী বা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বিরত থাকতে মনকে শক্ত করে। কেন এটার গুরুত্ব, রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো, রোজা যখন শেষ হয়ে যাবে, আমাকে মনে করতে হবে, যে ভাবে আমি আমার ক্ষুধা তৃষ্ণার বিরুদ্ধে লড়েছি, আমাকে প্রতিনিয়ত আমার চোখের আকাঙ্খার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমাকে আমার জিহ্বার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমাকে আমার মুখের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, আমাকে আমার অনেক আকাঙ্খার বিরুদ্ধে লড়তে হবে, হারাম থেকে বিরত থাকতে হবে, আমাকে আমার হরমনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, আমাকে এখন সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অর্থাৎ সবধরনের অন্যায়, অসত্য, অপকর্মের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, মন চাইলেই করা যাবেনা। আমাকে আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এর মাঝে দৃশ্যমান, তা হলো খাওয়া আর পান করা থেকে বিরত থাকা। এছাড়া সব কিছুই আছে রোজার মধ্যে।  

প্রিয় তরুণ প্রজন্মের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যদি তোমরা রোজা রাখো আর ঘরে বসে সিনেমা দেখো, তাহলে বুঝা গেল তোমরা রোজা রাখছো না। কারণ তোমার অন্তর তোমার কাছে হেরে গেছে। 

হাদিসে এসেছে যে খারাপ কাজ, খারাপ কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলোনা, তার  উপবাসের কোনই প্রয়োজন নেই। 

রোজা হচ্ছে বাস্তব জীবন মোকাবিলা করার জন্য আপনার প্রশিক্ষণ। যখন প্রশিক্ষণ চলে সেটা অনেক সহজ থাকে যেমন নিয়ন্ত্রিত আগুন, নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি। আল্লাহ কি করছেন, আল্লাহ কি আমাদের জন্য রোজাকে সহজ করেননি। কারণ তিনি রমজানে শয়তানকে -বন্দি করে রাখেন। আমাদের থেকে দুরে সরিয়ে রাখেন। তিনি কাজ সহজ করে দেন, যাতে আমাদের অন্তর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা সুযোগ পায়। যেই মাত্র রোজা শেষ হয় তখন কি হয়। শয়তান মুক্ত, আর আসল যুদ্ধ শুরু হয় তখন। এতদিন যে প্রশিক্ষণ নিলেন সেটা এখন কাজে দিবে। 

কুরআন সুস্পষ্ট পথ নির্দেশকারী এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রোজা শেষে যদিও আপনি রোজা রাখছেন না আপনার ভিতরে  কি আছে, “কুরআন” যা আপনাকে শক্তিশালী করছে। রমজান শেষ হবার পর আপনি আরও শক্তিশালী হবেন, কারণ আপনার অন্তরে আরও বেশি কুরআন আছে। পুরো ৩০ দিন রোজা রেখে যে প্রশিক্ষণ নিলেন, তারপর আপনি যদি আপনার অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তবে বুঝতে হবে আপনার প্রশিক্ষণ যথাযথ হয়নি। রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়েছে। সঠিকভাবে আপনি প্রশিক্ষণ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। রমজানের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে আপনার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আসুন আমরা রমজানে প্রশিক্ষণ নিই এবং সেই অনুযায়ী বছরের বাকি সময় পথ চলি। কুরআন দিয়ে জীবন গড়ি। 

(লেখক সাবেক অধ্যক্ষ,মানবাধিকার কর্মী,সাংবাদিক)


No comments

Powered by Blogger.