পড়ালেখার পাশাপাশি হাতপাখা তৈরী আর ভ্যানের চাকা ঘুরিয়ে সংসার চালাচ্ছেন কলেজ ছাত্র জুয়েল রানা

 স্টাফ রিপোর্টার-

কলেজ ছাত্র পিতৃহীন জুয়েল রানা পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছেন তালপাখা তৈরীর কাজে। এখন তালপাখা বিক্রির মৌসুম, তাই দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই কাজে তার বিধবা মা শেফালী বেগমও সহযোগিতা করেন। এবছর ১৯ হাজার তালপাখা তৈরী করেছেন, ইতিমধ্যে ২ হাজার বিক্রিও হয়েছে।

হতদরিদ্র ছেলেটি বাড়িতে হাতপাখা তৈরীর পাশাপাশি বাবা মিন্টু সর্দ্দারের রেখে যাওয়া ভ্যান নিয়েও বাইরে বের হন। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন গড় ৪শত টাকা আয় করেন। যা দিয়ে তাদের ৪ জনের সংসার চলে। তালপাখা বিক্রির টাকা পড়ালেখার খরচ করেন, কিছু জমিয়ে রাখেন ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। জুয়েল রানা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পারিয়াট গ্রামের মৃত মিন্টু সর্দ্দারের ছেল। তার ভাষায় এই সময়ে তাদের গ্রামে তালপাখা তৈরীর ধুম পড়ে যায়, বাজারে এর চাহিদাও বেশি থাকে। তাই সকলের মতো তিনিও এই পাখা তৈরীর কাজ করেন। তাদের তৈরী এই পাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। 

বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টায় পারিয়াট গ্রামে জুয়েল রানা’র বাড়িতে গিয়ে তাকে বাড়ি পাওয়া যায়নি। মা শেফালী বেগম তখন পাখা তৈরীর কাজ করছিলেন। উঠে এসে জানালেন জুয়েল ভ্যান নিয়ে বের হয়েছেন। এরপর মুটোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, পাশের একটি বাজারে ভাড়া নিয়ে এসেছেন। একটু অপেক্ষা করেন চলে আসছেন। মা শেফালী বেগম বসার ব্যবস্থা করে বললেন এই ছেলেটা দিন-রাত পরিশ্রম করে। আবার পড়ালেখাও করছে। স্বামীর মৃত্যুর পর জুয়েল নিজেই সংসারটা বাঁচিয়ে রেখেছেন। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলে আসেন জুয়েল। এসেই জানালেন, প্রতিদিন সংসারে অনেক খরচ ভ্যান না নিয়ে বেরুলে চলবে কিভাবে। 

তালপাখা তৈরীর গল্প জানতে চাইলে জুয়েল রানা জানান, তাদের গ্রাম পারিয়াটে কমপক্ষে ২০ টি পরিবার এই পাখা তৈরীর কাজ করেন। তার বাবাও ভ্যান চালানোর পাশাপাশি মৌসুমে পাখা তৈরী করতেন। অভাবের সংসার হওয়ায় ছোট অবস্থায় পড়ালেখার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে বাবার কাজে সহযোগিতা করতে হতো। এখান থেকেই পাখা তৈরীর কাজ শিখেছেন। কিন্তু কখনও ভাবেননি এই অল্প বয়সে পড়ালেখার সঙ্গে এই কঠিন কাজটিও তাকে করতে হবে। জুয়েল রানা জানান, ২০১৯ সালের ১৫ জুন বাড়িতে পরিচর্জা করার সময় তার বাবা মিন্টু সর্দ্দারকে একটি গরু সিং দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। এরপর থেকে পরিবারের সব দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। 

জুয়েল রানা আরো জানান, ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গাছ থেকে পাতা কাটতে হয়। উচু গাছে তিনিই উঠে পাতা কাটেন। এরপর বাড়িতে এনে পাখা আকৃতির সাইজ করেন। তারপর বান্ডিল বেঁধে ফেলে রাখেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস এলেই পাখা তৈরী শুরু হয়ে যায়। বান্ডিল থেকে পাতা খুলে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা পানিতে রাখেন। এরপর আবার শুকিয়ে নেন। তারপর নকশা তৈরী আর সেলাই এর কাজ করেন। মাঝে বাঁশের শলা তৈরী করে নেন। এভাবে তালপাখা তৈরী হয়ে যায়। তার ভাষায় একটি পাখা তৈরী করতে ৮ থেকে ৯ টাকা খরচ হয়। যা বাজারে ১৫ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। তিনি এবছর ১৯ হাজার পাখা তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছেন, যার মধ্যে কিছু সম্পূর্ন তৈরী হয়েছে আবার কিছু পাখার সামান্য কাজ বাকি আছে। এ বছর লক্ষাধিক টাকার পাখা বিক্রি করবেন আশা করছেন। 

জুয়েল রানা জানান, বাবার মৃত্যুর পর সংসার কাঁধে নিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৩.৮৭ পেয়েছেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া আমেনা খাতুন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আশা করছেন এইচ.এস.সি পরীক্ষাতেও তিনি ভালোভাবে পাশ করবেন। তিনি জানান, এখন প্রতিদিন সকালে ৬ টায় ঘুম থেকে উঠেন। এরপর ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, একটা নিযমিত ভাড়া আছে সেখানে। তারপর বাড়িতে আসেন। দুপুর পর্যন্ত ভ্যান নিয়ে ভাড়া মারেন। বিকালে পাখা তৈরীর কাজ করেন। রাতে পড়ালেখা করেন। তারা তিন ভাই, বড় ভাই রানা ইসলাম (২১) স্যালো ইঞ্জিন ভ্যান (লাটা) চালান। এতে যা পান তা তারই দৈনন্দিন খরচ হয়। আর ছোট ভাই আরাফাত সর্দ্দার (১২) পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। তিনি জানান, পুজি না থাকায় বেশি পাখা তৈরী করতে পারেন না। ৩০ হাজার টাকা পুজি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। 

মা শেফালী বেগম জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেই সংসারের হাল ধরেছেন। বড় ছেলে তেমন একটা আয় করতে পারেন না। দুই কক্ষের টিনের ঘরে বসবাস করেন। কষ্টে চলে তাদের সংসার। আশা করছেন ছেলে পড়ালেখা শিখে একটা চাকুরী পেলে কষ্ট দূর হবে। কিন্তু ভয় সংসার চালাতে এতো কাজ যার কাঁধে সে পড়ালেখায় ভালো করতে পারবে কিনা। তিনি বলেন, ছেলের পরিশ্রমে তিনি নিজেও অংশ নেন। 

পারিয়াট গ্রামের মন্টু সর্দ্দার জানান, তাদের গ্রামের আয়নাল বিশ্বাস, সমির বিশ্বাস, আজিজুল বিশ্বাস, আহম্মদ আলী, বাদশা মিয়া, মাসুদ বিশ্বাস সহ ২০ টি পরিবার এই তালপাখা তৈরী করেন। তিনি এবছর ২৫ হাজার পাখা তৈরী করেছেন। এভাবে প্রায় সব বাড়িতেই হাজার হাজার পাখা রয়েছে। এই সময় পাখার চাহিদাও বেশি থাকে বলে জানান। তার ভাষায়, বাড়িতে বিদ্যুতের পাখা থাকলেও হাত পাখার প্রয়োজন হয়। যে কারনে তালপাখার কদর এখনও কম নয়। আর তাদের গ্রামটিকে অনেকে পাখাপল্লী হিসেবে চেনেন। 

No comments

Powered by Blogger.