রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত হলে বন্ধ হবে দুর্নীতি-অর্থ পাচার

  এম এ কাদের-

মানুষ তার স্বাভাবিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সঞ্চয় করে। আর এ অর্থ সঞ্চয় করতে গিয়ে অপকর্ম ও দুর্নীতির দিকে ঝুকে পড়ে। রোগ-শোকে ভাল চিকিৎসা এবং সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে উচ্চ শিক্ষার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। অন্য চাহিদাগুলোর জন্য অধিক সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়না।

সব মানুষই সুখী হতে চায়, আর এ সুখ অনেকটা নিশ্চিত করে টাকা। এ কারনেই বৈধ, অবৈধ ভাবে মানুষ সঞ্চয় ও বিদেশে অর্থপাচারের  দিকে ঝুঁকে পড়ে। দেশ থেকে অর্থপাচারের ভয়বহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমদানীতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানীতে আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে পুঁজি পাচার। এছাড়া রপ্তানী আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে বিনিয়োগ করা। একারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। আই এম এফ এর হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আই এম এফের হিসাব মতে নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে। সরকারের ঘোষনা, এটা ছিল ৩২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। 

বাংলাদেশের  মানুষ সুখের মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে। পৃথিবীর ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪ তে। আর সবচেয়ে সুখী দেশ হল ফিনল্যান্ড। এছাড়া কানাডা, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, অষ্টেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক এ সমস্ত দেশে সরকারীভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার কারনেই এরা আজ সুখী দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এসব দেশে দুর্নীতি নেই বললেই চলে। তাছাড়া শিক্ষার হারও অনেক বেশি।

পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ফ্রী হওয়ার কারনে শিক্ষার হার অনেক বেশি এবং দুর্নীতি ও কম। এ দেশগুলোর  মধ্যে জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা অন্যতম। পৃথিবীর মধ্যে জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, স্পেন, অস্ট্রিয়া এসব দেশের জনগনদের মানসিক চাপ না থাকায় এরা অনেক সুখী

মানুষ  নিশ্চিত সুখের জন্য আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা সুখী দেশগুলোয় পাচার করে প্রাইম লোকেশনে বাড়ি ক্রয় করে সেকেন্ড হোম নিশ্চিত করছে।  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কানাডার বেগমপাড়া সহ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, দুবাই। দুদকের তথ্যমতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে। শুধু দুবাই শহরেই ৪৫৯ জন বাংলাদেশীর নাম পাওয়া গেছে যারা প্রচুর অর্থ পাচার করে বাড়ী কিনেছে। এতে একদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার চরম ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা এখনই থামানো না গেলে ক্রমান্বয়ে অর্থপাচার বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধার সম্মুখীন হতে হবে।

পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ ফিনল্যান্ড, গত ৬ বছর ধরে একটানা সুখের মাপকাঠিতে এক নম্বরে আছে দেশটি। এর অন্যতম কারন হল দেশটিতে মানুষের মৌলিক চাহিদার সবগুলোই সরকারীভাবে নিশ্চিত করা হয়। আর এ কারনেই মানুষের কোন দুশ্চিন্তা নাই। এদেশ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবার জন্য সমবন্টন নিশ্চিত করা হয়। সন্তান জন্মের পর থেকে মা তার নিজের সন্তানকে লালন-পালনের জন্য সরকার থেকে একটা বড় ভাতা পেয়ে থাকে।

বর্তমানে জনবহুল আমাদের এ দেশে অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। এদের কর্মসংস্থানের তেমন কোন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিবার, সমাজ ও দেশের বেকারত্বের বোঝা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা সকলের জন্য জাতীয়ভাবে নিশ্চিত করা হলে মানুষ মানসিক চাপমুক্ত হয়ে নিশ্চিত সুখী হবে এবং অধিক সঞ্চয় করা থেকে বিরত থাকবে। ফলে দুর্নীতি করে সঞ্চয় করার দরকার হবে না। আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা আর অবৈধভাবে দেশের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার করবে না।

চিকিৎসা ও শিক্ষা সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করলে দেশের অনেক অবকাঠামো ও কর্মের সৃষ্টি হবে। এতে করে বেকার সমস্যা অনেকাংশে দুর করা সম্ভব হবে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে প্রতিদিন দেশের হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাওয়া বন্ধ হবে। ফলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে যাওয়া বন্ধ হবে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সৃষ্টি হলে আমাদের আশপাশের দেশ নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকেই চিকিৎসা ও মেডিকেল পড়তে আসবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে এবং দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। একই ভাবে পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করলে দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে, এতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা একেবারেই কমে আসবে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হবার পর বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী দেশে শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরী করে বিদেশে রাপ্তানী করলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি হলে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা দেশেই শিক্ষা গ্রহনের সুয়োগ পাবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এদেশে পড়তে আসলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সহ দেশের ভাবমূতি উজ্জ্বল হবে।

দেশের চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। বিশ্বের সুখী দেশগুলোর প্রত্যেক নাগরিকের আয়ের একটা অংশ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার নিয়ম আছে। আমাদের দেশের নাগরিকদের আয়ের ২০% থেকে ২৫% ট্যাক্স হিসেবে সরকারের কোষাগারে জমার নিয়ম করলে চিকিৎসা ও শিক্ষা এ দুটি বিষয়ে অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন সহজ হবে। দেশের ধনী-গরীব প্রতিটি মানুষ সরকারের নিকট থেকে সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে, এতে করে প্রত্যেকটি মানুষই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে। সন্তানের লেখাপড়া ও নিশ্চিত ভবিষ্যত, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারের উপরে থাকায় ও অসুস্থ রোগীদের দেশেই সুচিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের কোন মানসিক চাপ থাকবে না। ফলে তারা নিশ্চিত সুখী হবে।      

বহি বিশ্বে যে দেশের মানুষ যত সুখী, সে দেশ তত উন্নত। দেশের মানুষের সুখের সাথে তার উন্নয়ন নির্ভর করে। যার মানসিক চাপ যত কম সে তত সুখী। মানুষের মানসিক চাপে তার আয়ুর উপর প্রভাব পড়ে। যে দেশের মানষের মানসিক চাপ যত কম, আয়ু তত বেশী। আমাদের দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা জাতীয় ভাবে নিশ্চিত করা হলে দেশের জনগন নিশ্চিত সুখী হবে। ধনী, গরীবের বৈষম্য দূর হবে, সর্বোপরি দেশের একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে। দেশ থেকে সন্ত্রাস দুর্নীতি বন্ধ হবে, মাদক থেকে অনেকে ফিরে আসবে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকায় বিদেশীরা আমাদের দেশে মিল, কলকারখানায় বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহী হবে। এতে করে ২০৪১ সালে নয় এর অনেক আগেই দেশ উন্নত রাষ্টে পরিনত হবে।

 লেখক-

সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

ইমেল- makader958@gmail.com


 

                                                      



No comments

Powered by Blogger.