কালীগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা

 



 স্টাফ রিপোর্টার -
বিলুপ্তির পথে আজ ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিলো এই খেলা। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় খেলোয়াড়দের দলনেতার উদ্যোগে গড়ে উঠত লাঠি খেলার দল। আর পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো এই খেলা।

ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো কোন গ্রামের কোন মাঠে বা কার বাড়িতে কোন সময় এই খেলা অনুষ্ঠিত হবে। নিজেদের নিত্যদিনের কাজ দ্রুত সমাপ্ত করে ছুটে যেত খেলা দেখার জন্য। বাড়ির আঙিনায় এই খেলা দেখার জন্য ঘরের চালে গাছের ডালে ভীড় জমাতো যুবকেরা আর বেড়ার ফাঁকে, জানালা খুলে খেলা দেখতো মা-বোনেরা । আর সে দিনের সেই কাঠের টুল আর পিড়ি পেড়ে বসে খেলা দেখত বৃদ্ধরা । দর্শকদের হাতে তালি আর মুখের জয়ধ্বনি খেলোয়াড়দের আনন্দ যোগাত।

কিন্তু কালের আবর্তে আজ লাঠি খেলার সেই বিনোদন ভুলতে বসেছে দেশের মানুষ। বর্তমানে নতুন করে লাঠি খেলার কোনো সংগঠন বা দল তৈরি হচ্ছে না। কালের আর্বতে সেই লাঠি খেলার স্থান আজ দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাটমিন্টন। তাছাড়াও অতীতের খেলার পরিবর্তে মোবাইলে চলছে পাপজি, ফিরিফার্য়ার সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা। যেখানে ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যেরা স্থান পেলেও গ্রাম-বাংলা দরিদ্র পরিবারের লোকেরা আধুনিক যুগের খেলা দেখার জন্য ছুটি যায় প্রতিবেশীদের ঘরের টিভির কাছে, কিন্তু শত বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে গ্রাম-বাংলায় আজও দুয়েকটি জায়গায় চলে অতীতের লাঠি খেলা।

খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢোল আর লাঠির তালে তালে নাচ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষে লাঠির আঘাত হতে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টায় টান টান উত্তেজনায় বিরাজ করত খেলোয়াড় ও দর্শকদের মাঝে।

বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছিয়ে দিতে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা। বুধবার (১৬ এপ্রিল) সকালে গোপালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ইলিয়াস মোল্যার সভাপতিত্বে এ খেলার আয়োজন করা হয়।
এ সময় স্কুল মাঠে দুরদূরান্ত থেকে আগত লাঠিয়াল দলের অংশগ্রহণে জমজমাট খেলা দেখতে মাঠে জড়ো হন হাজারো দর্শক। ঢাক-ঢোল আর কাঁসার ঘণ্টার তালে জমে উঠেছিল স্কুল মাঠ এলাকা। প্রতিপক্ষের আঘাত ঠেকাতে আর পাল্টা আক্রমণে মেতে উঠেন লাঠিয়ালরা। বর্ণাঢ্য পরিবেশ ও লোকজ সংগীতের তালে তালে প্রদর্শিত হয় নানান আকর্ষণীয় লাঠি খেলার কলাকৌশল, যা উপভোগ করেন দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শকেরা। দৃষ্টিনন্দন এই কসরতে উচ্ছাসিত দর্শকেরা করতালি আর উৎসাহে ভরিয়ে তোলেন মাঠ।

উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের  বলরামপুর গ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক রেজাউল ইসলাম জানান, এই খেলার জন্য লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়। তবে প্রতিটি লাঠি হয় প্রায় তৈলাক্ত । প্রত্যক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। খেলার স্থানে লাঠির পাশাপাশি যন্ত্র হিসেবে ঢোল, কনেট, ঝুনঝুনি ও বিভিন্ন প্রকার বাঁশি ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়াও সঙ্গীতের পাশাপাশি এ খেলার সঙ্গে চুড়ি নৃত্যও দেখানো হতো।

উপজেলার জামাল ইউনিয়নের দুধরাজপুর গ্রামের আবু জাফর বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আমাদের অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লাঠি খেলা রয়েছে। আগে দেখতাম, গ্রামের সাধারন মানুষেরা বাংলা বর্ষবরণ, বিবাহ, চড়কপূজা, সুন্নতে খাৎনা উপলক্ষে এ লাঠি খেলা আয়োজন করতো। আমাদের এই এলাকায় ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আর মুখে গ্রামের অনেকেই এই লাঠি খেলায় পারদর্শী ছিলেন । আমরা তাদের লাঠি খেলা দেখেছি। সে সময়  লাঠি খেলা দেখতে গ্রামের নারী-পুরুষ সহ সকল শ্রেণীর লোক ভীড় জমাতো। আমাদের উচিত গ্রাম বাংলার পুরাতন সকল ঐতিহ্য ধরে রাখা। 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-আহবায়ক হামিদুল ইসলাম হামিদ। এ সময়ে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, আবহমান বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে ঘিরে এমন প্রাণবন্ত  আয়োজন নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ ধরনের আয়োজন স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখে, তেমনি নতুন প্রজন্মের মাঝেও দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। খেলা শেষে বিজয়ী দলের মাঝে পুরস্কার বিতরন করা হয়।




No comments

Powered by Blogger.