লাইফ সাপোর্টে ওসমান হাদি রওনা হলো সিঙ্গাপুরের পথে; নির্বাচন বানচালের গভীর ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা,সরকার যাচ্ছে কঠোর অবস্থানে
নিজস্ব প্রতিবেদক সিফাত বিন সিদ্দিক :
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে রাজধানীর বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদি। গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচারণার সময় এই বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, এটি নিছক কোনো হত্যাচেষ্টা নয়, বরং আসন্ন নির্বাচন বানচাল এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার এক গভীর ষড়যন্ত্র বা ‘মাস্টারপ্ল্যান’-এর অংশ।
গত শক্রবার জুমার নামাজের পর বিজয়নগর এলাকায় গণসংযোগ করছিলেন ওসমান হাদি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুপুর সোয়া ২টার দিকে হেলমেট পরা তিন দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেলে এসে খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। একটি গুলি তার বাম চোয়াল ভেদ করে মাথায় আঘাত করে।
তাকে দ্রুত উদ্ধার করে প্রথমে ঢামেক ও পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান জানিয়েছেন, “রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন (Critical)। গুলিটি মস্তিষ্কের সংবেদনশীল জায়গায় আটকে আছে। তিনি বর্তমানে ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্ট) আছেন। আগামী ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।”
ওসমান হাদির ওপর এই হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সবার কণ্ঠেই একটি অভিন্ন শঙ্কা—নির্বাচন বানচালের পায়তারা।
বিএনপি: দলটির মহাসচিব এক জরুরি বিবৃতিতে বলেন, “ওসমান হাদির ওপর এই হামলা প্রমাণ করে ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা এখনো সক্রিয়। এটি নির্বাচন বানচাল এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার গভীর চক্রান্ত। আমরা অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানাই।”
জামায়াতে ইসলামী: দলটির আমির এই ঘটনাকে ‘জুলাই বিপ্লবের চেতনার ওপর আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “যারা দেশকে আবারও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়, তারাই এই অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। সরকারকে এখনই কঠোর হতে হবে।”
এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ: এনসিপি নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ছাত্রনেতার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া দুঃখজনক।” গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “নির্বাচনের আগে লাশ ফেলার রাজনীতি শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতা এই ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।”
এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটও পৃথক বিবৃতিতে এই হামলার বিচার দাবি করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই শুক্রবার রাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও শাহবাগ উত্তাল হয়ে ওঠে।শবিবার সকালেও ‘সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তাদের স্লোগান ছিল, “হাদি ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।” শিক্ষার্থীদের দাবি,খুব দ্রুত হামলাকারীদের নাম ও পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “এটি নির্বাচন ভণ্ডুল করার একটি পরিকল্পিত ছক। সরকার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।”
তিনি ঘোষণা করেন হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার। রাজধানীজুড়ে চেকপোস্ট জোরদার এবং ‘অপারেশন সিকিউর পোল’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু।সকল প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার বা বাতিল করার একটি পায়তারা চলছে। ওসমান হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের একজন সম্মুখযোদ্ধা হওয়ায় তাকে টার্গেট করা হয়েছে যাতে ছাত্রসমাজকে উসকে দিয়ে বড় ধরনের দাঙ্গা বাঁধানো যায়। তাকে আজ সোমবার এয়ার এম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকার চিকিৎসার পুরো অর্থ বহন করবে বলে অর্থ উপদেষ্টা নিশ্চিত করেছেন।
এই ঘটনার জেরে সাধারণ ছাত্রজনতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবরুদ্ধ করে এবং দ্রুত ওসমান হাদির হামলাকারীকে ধরা সহ তিনটি দাবি পেশ করে। তারা দায়িত্ব পাললে ব্যর্থ হলে আইন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার পদ ত্যাগের জন্যও আন্দোলনে নামার হুমকি দেন।
ওসমান হাদির উপর হামলার ঘটনায় গতকাল রোববার রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় একটা মামলা করা হয়েছে। মামলায় ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
এই ঘটনা সাধারণ ভোটার ও অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে। রাজনীতির মাঠ এখন থমথমে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি দ্রুত এই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে না পারে এবং হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে।

No comments