একাত্তরের বিজয়: মিত্রশক্তির সহায়তা নাকি বাঙালির রক্তস্রোতের ফসল?ফিরে দেখা ইতিহাস
সিফাত বিন সিদ্দিক স্টাফ রিপোর্টার :
প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর এলেই বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করার এক অলিখিত প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে সীমান্তের ওপার থেকে আসা বক্তৃতায় প্রায়শই এই বিজয়কে একটি বিশেষ দেশের নিষিদ্ধ করলে বললে ভারতীয়দের 'দান' হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস থাকে। কিন্তু ইতিহাসের কি বলে?একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে রমনা রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের যে দৃশ্য বিশ্ব দেখেছিল, তা ছিল কেবল ৯ মাসের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। কিন্তু এই চূড়ান্ত মুহূর্তটির ক্ষেত্র যারা প্রস্তুত করেছিলেন, যারা পাকিস্তানের সুশৃঙ্খল বাহিনীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল, তারা কোনো ভিনদেশি সৈনিক ছিল না; তারা ছিল এ দেশের কাদা-মাটি মাখা কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক এবং বিদ্রোহী বাঙালি সেনা। বিজয়ের আসল রূপকার সন্ধানে আমাদের তাকাতে হবে ২৫শে মার্চের কালরাত পরবর্তী সেই উত্তাল দিনগুলোর দিকে, যখন কোনো পরাশক্তি আমাদের পাশে ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশে নয়, বরং তা ছিল অস্তিত্ব রক্ষার এক স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ। অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতার জবাবে বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনী যে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা ছিল আধুনিক সমর ইতিহাসের এক বিস্ময়। বিশেষ করে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বিভ্রান্ত ও দিশেহারা জাতিকে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও যে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে উঠেছিল, তা পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গঠিত প্রবাসী সরকারের (মুজিবনগর সরকার) মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার ও তাদের রণকৌশলই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি, যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিল।
রণাঙ্গনের চিত্রটি ছিল আরও ভয়াবহ এবং গৌরবোজ্জ্বল। পাকিস্তানি বাহিনী কেবল ভারতের মিত্রবাহিনীর কাছে হার মানেনি, তারা মূলত হেরেছিল বাংলার দামাল ছেলেদের গেরিলা হামলার কাছে। বর্ষার কাদা-পানিতে যখন ভারী পাকিস্তানি ট্যাংক অচল, তখন লুঙ্গি পরা মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড হাতে তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসিক অভিযান কিংবা কাদেরিয়া বাহিনীর মতো স্থানীয় বাহিনীগুলোর প্রতিরোধ পাকিস্তানি সেনাদের মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। এই 'জনযুদ্ধ'ই পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে ডিসেম্বরে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে সহজ করে দেয়।
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, কিন্তু তা কি কেবলই নিঃস্বার্থ ছিল? ভারত প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে—এটি সত্য। তবে এর পেছনে তাদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও ছিল প্রবল। পাকিস্তানের দুই অংশের ভাঙন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ছিল অপরিহার্য। তাছাড়া, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতের দীর্ঘদিনের শত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করার এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল। তাই ভারতের সহযোগিতাকে কেবল 'দান' হিসেবে দেখা ভুল; এটি ছিল পারস্পরিক স্বার্থের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। অন্যদিকে, স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে আমেরিকা ও চীন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘে ভেটো প্রদান না করলে স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়তো আঁতুড়ঘরেই বিনাশ হতো। পরাশক্তিগুলোর এই দাবার চালে বাংলাদেশ ছিল কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু ঘুঁটি চালনা করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাঙালিরাই।
প্রকৃত বন্ধু কারা ছিল, তা বিচার করতে গেলে তাকাতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে। জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর কিংবা ফরাসি সাহিত্যিক অঁদ্রে মালরোর মতো বিদেশি নাগরিকরা, যারা কোনো রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছাড়াই কেবল মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন—তারাই ছিলেন আমাদের নিঃস্বার্থ বন্ধু। ভিনদেশি সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানি বর্বরতার খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই মানবিক সমর্থনটুকু না থাকলে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হতো না।
পরিশেষে, একাত্তরের বিজয় কোনো একক শক্তির দান নয়, তবে এর প্রধান ও মূল রূপকার নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা। ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন কূটনৈতিক বর্ম দিয়েছে, কিন্তু বুকের রক্ত ঢেলেছে ত্রিশ লাখ বাঙালি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর অনেক আগেই এ দেশের গেরিলারাই পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত করে ফেলেছিল। তাই আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে তার সঠিক ফ্রেমে দেখা জরুরি। বিজয় দিবসের স্যালুট কোনো বিদেশি জেনারেলের প্রাপ্য নয়, এই স্যালুট প্রাপ্য সেই নাম না জানা কিশোর মুক্তিযোদ্ধার, যে দেশের জন্য নিজের ভবিষ্যৎ উৎসর্গ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তার সন্তানের রক্তে, কোনো পরাশক্তির দয়ায় নয়।

No comments