নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে বিএড প্রশিক্ষণ


স্টাফ রিপোর্টার।।
বিএড এবং মাদরাসার ক্ষেত্রে বিএমএড সমমানের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন এক লাখ ৫৮ হাজার ৭২২ জন শিক্ষক।
অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি শিক্ষকের এই প্রশিক্ষণ নেই। এর মধ্যে ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের হার সবচেয়ে কম। ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণের বাইরে থাকা এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার যোগ্যতা হিসেবে বিএড প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-৪) বাস্তবায়নে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে গত মাসের শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে বিএড প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি এবং এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষকসংখ্যা চার লাখ ৩১ হাজার ৮২২ জন। এর মধ্যে বিএড প্রশিক্ষণ নেই এক লাখ ৫৮ হাজার ৭২২ জন শিক্ষকের। এর মধ্যে রয়েছেন এক লাখ ২৮ হাজার ৪৭৩ জন পুরুষ ও ৩০ হাজার ২৪৯ জন নারী শিক্ষক। পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ৩০ বছর বয়সী প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকের সংখ্যা চার হাজার ৯৮ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী শিক্ষক ৬০ হাজার ২৮১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী শিক্ষক ৬১ হাজার ৮৭ জন এবং ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী শিক্ষক ৩০ হাজার ২৫৬ জন।
প্রশিক্ষণবিহীন এসব শিক্ষকের মধ্যে বেশির ভাগই মাদরাসার। দাখিল ও আলিম মিলিয়ে এক লাখের বেশি এমপিওভুক্ত মাদরাসা শিক্ষক রয়েছেন। যাঁদের বেশির ভাগের বিএড বা সমমানের ডিগ্রি নেই। সর্বোচ্চ ১০ হাজার শিক্ষকের বিএড পর্যায়ের ডিগ্রি রয়েছে। কয়েক বছর আগে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর গঠিত হলেও শিক্ষকদের মান উন্নয়নে তারা এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি বলে জানা গেছে।
মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ মাদরাসা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বিএমটিটিআই) মাধ্যমে শিক্ষকদের ব্যাচেলর ইন মাদরাসা এডুকেশন (বিএমএড) করার সুযোগ করে দিয়েছি। খুব স্বল্প খরচে শিক্ষকরা এখান থেকে এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এরই মধ্যে কিছু শিক্ষক বিএমএড করেছেন। তবে অনেকেরই আগ্রহ কম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক বিএড বা সমমানের ডিগ্রি গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হলে সবাই বাধ্য হতেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ভালো শিক্ষক লাগবেই। ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদেরও মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বর্তমানে প্রশিক্ষণটা যে পদ্ধতিতে দেওয়া হয় এর পদ্ধতি ও কলাকৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষানীতিতে এডুকেশন সার্ভিস কমিশনের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু তা গত ৯ বছরেও হয়নি। এটি করা গেলে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগে আর কোনো সমস্যা হতো না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এক লাখ ৫৮ হাজার ৭২২ জন শিক্ষককে বিএড প্রশিক্ষণ দিতে ব্যয় কত হবে, সময় কত লাগবে, প্রতি ব্যাচে কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন, সময়ের দিক থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পদ্ধতি কেমন হবে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে সম্প্রতি ব্যানবেইসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এ নিয়ে আরেকটি সভা ডাকা হবে। সেখানে প্রশিক্ষণের পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হবে।
প্রশিক্ষণের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সভায় (গত ডিসেম্বর) বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের কমপক্ষে এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তবে ৫২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষকদের জন্য সংক্ষিপ্ত কোর্সের আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএড বা ন্যূনতম এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ এবং ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব করা হবে।
জানা গেছে, শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ না থাকায় যেসব ছোটখাটো প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন তাঁরা, তাতে ঠিকমতো আত্মস্থ করতে পারছেন না। ফলে শিক্ষার্থীরাও সৃজনশীলে দক্ষ হতে পারছে না। গত বছর মে মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের করা একাডেমিক সুপারভিশনে দেখা যায়, ৫৭.২৮ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। আংশিক প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন ২৬.২৭ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ১৬.৪৫ শতাংশ শিক্ষক। অর্থাৎ ৪২ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন না।
 এ পর্যন্ত কতজন শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এর হিসাব কারো কাছে নেই। তবে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে পরীক্ষা পদ্ধতি উন্নয়ন বিষয়ে দুই লাখ ২৪ হাজার শিক্ষকের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষককে সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে শিক্ষকদের তিন দিনের সৃজনশীল প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বর্তমানে দেওয়া হয় ছয় দিন।
মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. আব্দুল মালেক বলেন, ‘অনেক শিক্ষকেরই বেসিক প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁরা তা আত্মস্থ করতে পারেন না। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা সব শিক্ষকের এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করব। বর্তমানে যাঁদের প্রশিক্ষণ নেই জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (টিটিসি) যাতে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার পান সে বিষয়েও আলোচনা চলছে। এ ছাড়া এনটিআরসিএ যাতে বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয় সে ব্যাপারেও আমরা তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠাব।’


No comments

Powered by Blogger.