কালীগঞ্জের হাট-বারোবাজার স্কুলে মহতি ঠিকানায়,উপকৃত হচ্ছেন হতদরিদ্ররা

স্টাফ রিপোর্টার-
বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা আছে কাঠের আলনা আর স্টিলের আলমিরা। আলনায় ঝুলানো আছে ছেলেদের পুরাতন জামা-প্যান্ট, আর আলমিরায় রাখা হয়েছে মেয়েদের নানান পোশাক। হতদরিদ্ররা নিজের পছন্দে এখান থেকে কাপড় নিচ্ছেন, আর অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীরা তার অব্যবহৃত কাপড়টি দিচ্ছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক সকলেই এই কাপড় নেন এবং দেন। এভাবে চলছে মহতি ঠিকানার কার্যক্রম।
শুধু পুরাতন কাপড় নয়, এই বিদ্যালয়ের ছোট ছোট আয় আর শিক্ষক ও এলাকার দানশীল মানুষের অনুদানে হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় নতুন কাপড়। মহতি ঠিকানা’র নামে পৃথক একাউন্ট রয়েছে তাদের। যার পরিচালনার জন্য পৃথক কমিটিও আছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটাই প্রত্যাশা এই প্রতিষ্ঠানের কেউ যেন জামা-কাপড়ের কষ্ট না পান। জামা-কাপড়ের পাশাপাশি তারা শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা-কলম-কাগজও দিয়ে থাকেন। এই মহতি ঠিকানা গড়ে তুলেছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার হাট-বারোবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে। তারা জানান, হাট-বারোবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। স্থানিয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ধারে বারোবাজার নামক স্থানে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই স্কুলে ৭৮৩ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। শিক্ষক আছেন ২০ জন, যার মধ্যে ২ জন খন্ডকালীন শিক্ষক। বিদ্যালয়ে ভবন আছে ২টি, যেখানে শ্রেণীকক্ষ আছে ১৯টি। এছাড়া অফিস কক্ষ ২টি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম ৪টি, লাইব্রেরি ১টি, মুক্তিযোদ্ধা কর্ণার ১টি, ছাত্রী কমনরুম ১টি, নামাজঘর ১টি, সততা ষ্টোর ও মহতি ঠিকানা ১টি ও ১টি বিজ্ঞানাগার রয়েছে। এছাড়া নতুন একটি চারতলা ভবন নির্মান চলছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৫ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর স্বপ্ন দেখেন কিভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে শতভাগ ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা যায়। এরপর ওই বছরের শেষ দিকে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ ডিজিটাল হয়েছে। তারা সকল পরীক্ষার ফলাফল অনলাইনে দিচ্ছেন। বিদ্যালয়ের সব ধরনের আয়-ব্যায় অনলাইনে হচ্ছে। বিদ্যালয়ের একাউন্টে টাকা জমা হয় শিওরক্যাশের মাধ্যমে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারি ও শিক্ষার্থীরা কে কখন বিদ্যালয়ে আসছেন তা সংরক্ষন করছে ওয়েব সাইট। এছাড়া তাদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত চলছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস। এছাড়া ফেসবুকের মতোই শিক্ষকরা সব সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। শিক্ষার্থীরাও ওই সাইট ব্যবহার করে শিক্ষকদের কাছ থেকে পড়ার বিভিন্ন বিষয় জেনে নিতে পারছে।

প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, এতোকিছুর পর ২০১৮ সালে তারা চিন্তা করেন এলাকায় এখনও অনেক অসহায় দরিদ্র মানুষ রয়েছে। যাদের সন্তানেরা ঠিকমতো কাপড় পান না। অনেক অভিভাবক আছেন যারা একটা পোশাকের জন্য বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসতে লজ্জা পান। আবার অনেকে আছেন ঠিকমতো খাতা-কলম-কাগজ কিনতে পারে না। এদের কথা চিন্তা করে তারা প্রতিষ্ঠা করেন মহতি ঠিকানা। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে একটি আলনা আর একটি আলমিরা দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি দেখাশুনা করার জন্য একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী বাচ্চারা এবং তাদের অভিভাবকরা পুরাতন কিন্তু এখনও ব্যবহারযোগ্য জামা-কাপড় রেখে দেন। যারা অসহায় হতদরিদ্র তারা এখান থেকে পছন্দ করে নিয়ে যান। ছেলে-মেয়ে উভয়ের পোশাক এখানে রাখা হয়। শিক্ষকরাও তাদের পুরাতন কাপড় এখানে রেধে দেন। যা অসহায় অভিভাবকরা নিয়ে যান। এক বছর লেন-দেন চলছে বলে জানান দায়িত্বে থাকা শিক্ষক শ্যামল কুমার। তিনি জানান, প্রায়ই কাপড় লেন-দেন হচ্ছে। প্রথম দিকে অনেকে লজ্জা পেলেও এখন অনেকেই ব্যবহার করছেন।

প্রধান শিক্ষক আরো জানান, ২০১৮ সালে এই উদ্যোগ নিয়ে ২০১৯ সালের শুরুতেই ৭০ জন অসহায় শিক্ষার্থীকে নতুন পোশাক দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের ছোট ছোট আয়, শিক্ষকদের আর এলাকার মানুষের দেওয়া অনুদানে তারা এই পোশাক দেন। এ সময় বেশি কিছু শিক্ষার্থীকে খাতা, কলম ও কাগজ দেন। শিক্ষক সোহেল রানা জানান, তারা এই মহতি ঠিকানার জন্য একটি পৃথক একাউন্ট করেছেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বারোবাজার শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব- ০২১১১২২০০০০৬৯০৪ নম্বর এই একাউন্টটি প্রধান শিক্ষক ও তার (সোহেল রানা) যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়। এই একাউন্টে অনুদান হিসেবে জমা সব টাকাই মহতি ঠিকানার কাজে ব্যবহৃত হয়।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে জানায়, তার একটাই পোশাক ছিল। অনেক সময় ময়লা হয়ে যেতো, আবার অনেক সময় ভিজে থাকায় পরতে পারতেন না। এই ঠিকানা থেকে সে একটি পোশাক পেয়েছে। তারই এক বান্ধবী ওই পোশাকটি রেখেছিল। সেখান থেকে সে নিয়েছে। এরকম অনেকে নিচ্ছে বলে সে জানায়।

এ বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান রঞ্জু জানান, বর্তমান প্রধান শিক্ষক যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানটি ডিজিটাল হয়েছে। এখন মহতি ঠিকানা যেটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এতে হতদরিদ্ররা উপকৃত হচ্ছেন। এটা মানবতার কাজ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

No comments

Powered by Blogger.