বৈদ্যুতিক বাতির বিবর্তনে টমাস আলভা এডিসন

তরিকুল ইসলাম, ইবিঃ
বৈদ্যুতিক বাতির উন্নতি সাধনে সবচেয়ে বেশি যিনি ভূমিকা রাখেন, তিনি হলেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। তাঁর নকশা করা বাতিই আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির উদাহরণ বহন করে। তাঁর তৈরিকৃত বাতি বাসা-বাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী ছিল। তাই বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক তাঁকেই আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির জনক বলা হয়। বৈদ্যুতিক বাতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ নিয়ে আমাদের আলোকিত করে আসছে। বাতির এই বিবর্তন নির্ভর করে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও এদের কর্মদক্ষতার উপর৷ এই বৈদ্যুতিক বাল্ব, শব্দ রেকর্ডিং, মুভি ক্যামেরা বা চলমান ছবি ইত্যাদি সহ হাজারো আবিষ্কার রয়েছে তাঁর।
এডিসনের বাল্যকাল নিয়ে একটা চমকপ্রদ ইতিহাস প্রচলিত আছে৷ বাল্যকালে স্কুল থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল ৷ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁর মায়ের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন৷চিঠিটা পড়ে এডিসনের মা কাঁদতে লাগলেন ৷ তখন এডিসন তাঁর মায়ের কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলে চোখ মুছতে মুছতে মা বললেন, 'বাবা, এটা আনন্দের কান্না!' একথা বলেই ছেলেটিকে চুমু দিয়ে বললেন, 'আমার জিনিয়াস বাবা, তোকে চিঠিটা পড়ে শোনাই।'
মা আনন্দের সাথে চিৎকার করে স্যার‌ের ল‌েখার ভাষা বদল‌ে নিজের মত কর‌ে পড়তে লাগলেন, 'ম্যাডাম,
আপনার ছেলেটি সাংঘাতিক রকম জিনিয়াস ৷ আমাদের ছোট্ট শহরে ওকে শিক্ষা দেওয়ার মত শিক্ষক আমাদের নেই। তাই, যদি পারেন আপনার ছেলেকে বড় শহরে কোনো স্কুলে ভর্তি করে দিলে ভালো হয়। এই ছেলেটি একদিন বিশ্বে প্রচুর সুনাম অর্জন করবে।'
পত্রখানা পড়েই এডিসনের মা তাঁকে চুমু দিয়ে বললেন, 'এই জিনিয়াস ছেলেটিকে আমি নিজেই পড়াব।' মা নিজেই শিক্ষা দিয়ে ছেলেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের তথা সমগ্ৰ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বানালেন ৷
মায়ের মৃত্যর পর টমাস এডিসন একদিন সেই ছোট্ট গ্রামে মায়ের সেই ছোট্ট বাড়ীতে গিয়ে ঘর পরিষ্কারের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দ‌েয়া চিঠিটা পেলেন৷ চিঠিখানা পড়ে টমাস কেঁদে ফেললেন৷ তাতে লেখা ছিল,
ম্যাডাম, আপনার ছেলে টমাস আলভা এডিসন একজন মেন্টালি রিটার্ডেড।সে এতটাই নির্বোধ যে, তাকে শিক্ষা দেওয়ার মত ক্ষমতা আমাদের নেই।কারও আছে বলেও আমাদের জানা নেই। আপনার ছেলের কারণে আমাদের স্কুলটির সুনাম ক্ষুন্ন হবে।তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনার ছেলেকে স্কুল থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হল৷'
বৈদ্যুতিক বাতির জনক বলে খ্যাত এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী কানাডার মিলান শহরে৷ ১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেও পৃথিবীবাসির হৃদয়ে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন যুগের পর যুগ ৷
বৈদ্যুতিক বাতির আধুনিক কাঠামোঃ
বর্তমানে বাল্ব শব্দটি উচ্চারণ করলে যে চিত্রটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকেই ইনক্যানডেসেন্ট বাল্ব বলে।বাতির ফিলামেন্টের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে ইনক্যানডেসেন্ট বাল্ব জ্বলে ওঠে। নিষ্ক্রিয় গ্যাসে ভরা এক কাচের খোলসে এই ফিলামেন্ট রাখা হয়। ফিলামেন্ট হিসেবে টাংস্টেন নামের এক দুর্লভ ধাতু ব্যবহার করা হয়। এই পদার্থ আলোকে আরো উজ্জ্বল করতো। এছাড়াও এই বাতির উৎপাদন ও শক্তির খরচ ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম।
হ্যালোজেন বাল্বঃ
হ্যালোজেন বাল্ব ও সাধারণ ইনক্যানডেসেন্ট বাল্বের মধ্যে অমিল শুধুমাত্র একটা জায়গায়। আর তা হলো বাল্বের কাচের ভেতরে আবদ্ধ গ্যাস। নিষ্ক্রিয় গ্যাসের বদলে হ্যালোজেন বাতিতে ব্যবহার করা হয় হ্যালোজেন গ্যাস। হ্যালোজেন গ্যাস হিসেবে এই বাতিতে শুধু ব্রোমিন ও আয়োডিন ব্যবহার করা হয়। 
হ্যালোজেন বাতির মূল সুবিধা হলো, এর আয়ু পূর্বে আবিষ্কৃত বাতিগুলোর তুলনায় বেশি৷ এতেও ফিলামেন্ট হিসেবে টাংস্টেন ব্যবহার করা হয়। তবে অন্যান্য বাতির তুলনায় এটি খুব বেশি উজ্জ্বল। তাই কর্মক্ষেত্রে এই বাতির ব্যবহার বেশি করা হয়। অনুষ্ঠানে মঞ্চের আলো, চলচ্চিত্র নির্মাণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হ্যালোজেন বাতিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।তবে এই বাতির কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-এই বাতিগুলো ভীষণ গরম হয়। তাই জ্বালানো অবস্থায় খালি হাতে এগুলো ধরার সাহস করা উচিত নয়। তাছাড়া হ্যালোজেন বাল্ব বিস্ফোরিত হতে পারে। এজন্য এটি ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
এলইডি বাল্বের আগমনঃ
সেমিকন্ডাকটর ডিভাইস আসার পর তা প্রযুক্তি জগতের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে বৈদ্যুতিক বাল্বেও। এলইডি'র পুরো নাম হলো লাইট এমিটিং ডায়োড। এলইডি বাতি বলতে মূলত অনেক ছোট ছোট বাতিকে বোঝায়। এরকম অনেকগুলো ছোট বাতি একত্রিত করে বেশি আলো সম্বলিত বাল্বের আকার দেওয়া যায়।
এলইডির উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে এখন বিভিন্ন বর্ণের আলোও তৈরি করা সহজ হয়েছে। একই বাল্ব দিয়ে এখন কয়েকটি ভিন্ন বর্ণের আলো তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া ঘর আলোকিত করা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বাসার সৌন্দর্য বর্ধনে এখন এলইডি ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের বাতি তেমন গরম হয় না, নির্দিষ্ট সময় পর অকেজো হয়ে পড়ে না। তাই বর্তমানে এদের ব্যবহার তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিজ্ঞানের গবেষণা কখনো একটি নির্দিষ্ট আবিষ্কারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। নতুন কিছু আবিষ্কার হওয়ার পর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগুলোর বিবর্তন ঘটতে থাকে। এই বিবর্তনের লড়াইয়ে কিছু আবিষ্কার হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে তাদের তাৎপর্য ঠিকই টিকে থাকে। টমাস আলভা এডিসনের বানানো বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার হয়তো একদিন পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার এই আবিষ্কারের তাৎপর্য কখনো ফুরাবে না। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে আমরা আরো নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখতে পারবো। আর এখানেই লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।

No comments

Powered by Blogger.