বাবাদের পিপিই লাগে না

‘জীবনানন্দ দাশ’
তাঁর কবিতায় বলেছেন ---
তোমরা যেখানে সাধ চ'লে যাও আমি এই বাংলার পারে
র'য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে ;
দেখিব খয়েরী ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে - একবার -দুইবার - তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;’ –
সম্রাট শাহজাহান বলেছিলেন ‘পৃথিবীতে ভারী বস্তু হচ্ছে পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ।’ কথাটি আরেকবার প্রমাণিত হলো চট্টগ্রামে। যেন বুকে পাথর চেপে বসেছে। হিমালয়ের চেয়ে বড়, পৃথিবীর চেয়ে ভারী সেই পাথর যে বুকে চেপে বসেছে তা এক সন্তানহারা পিতার বুক!
করোনার এই কালে যখন আতঙ্ক ছড়িয়েছে সবখানে তখন সেই আতঙ্ক জয় করেছেন এক বাবা। কাজটি ঠিক কতটা কঠিন আপাতত: এই যুক্তি দূরে সরিয়ে বলা যায়, এখানে এক হতভাগ্য বাবার সন্তানস্নেহ জয়ী হয়েছে। মৃত সেই কিশোর আমাদের সময়ের অভিমন্যু। যে করোনার ক্ষমতা-চক্রবুহ্যের মধ্যে নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার।
ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। সেই ঘটনার একটি আলোকচিত্র ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে । আলোকচিত্রে দেখা যায় বাবা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা সন্তানের লাশ দু’হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে যারা পিপিই পরিহিত। অর্থাৎ তারা সুরক্ষিত থাকলেও বাবার পরনে সাধারণ লুঙি, টি-শার্ট। এই আলোকচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে- বাবাকে এভাবে অরক্ষিত রাখা হলো কেন ? শ্বেতশুভ্র পিপিই গায়ে ব্যক্তিরা নিজেকে বাঁচাতে চাইছে মৃত্যুভাইরাস থেকে। কিন্তু বাবা ? আলোকচিত্রটি বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রই বুঝি তুলে ধরেছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী ছেলের মৃত্যু হয়েছে। লাশের সৎকারে এগিয়ে আসেনি কেউ। না আত্মীয়-স্বজন, না পাড়া-প্রতিবেশী। কিন্তু বাবা ফেলে যাননি সন্তানের মৃতদেহ। বরং ঝুঁকি জেনেও বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। পিপিই ছাড়াই সন্তানের লাশ নিজ হাতে কবরে নামিয়েছেন। এই দৃশ্যটিই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
আমি সাংবাদিকতা করি। ছবিটি দেখার পর বুকটা কেঁপে ওঠে। মন বিষন্ন হয়। কিছুতেই যখন স্থির হতে পারছিলাম না, তখন পরিচিতদের মাধ্যমে কথা বলে যতটুকু জেনেছি, বাবার একান্ত ইচ্ছে ছিল, নিজ হাতে সন্তানকে কবরে নামাবেন। বাবার ইচ্ছের কাছেই হার মানে স্থানীয় প্রশাসনের সব যুক্তি।
আরো জানতে পারি, মৃত্যুকালে ছেলেটির বয়স হয়েছিল মাত্র ছয় বছর। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার বাবা ওমান প্রবাসী। দুই মাস আগে তিনি দেশে ফেরেন। জ্বর ও পায়খানা শুরু হলে ছেলেকে তিনি পটিয়া হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তার নমুনা পরীক্ষা করে করোনা পজেটিভ পান। এরপর পটিয়া উপজেলা প্রশাসন শিশুটিকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে ডা. অসীমকুমার নাথের তত্ত্বাবধানে ছিলো সে। অসীমকুমার নাথ নিজেই এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, শিশুটি জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়েরিয়ায় ভুগছিল।
আজ আমাদের এই করোনাক্রান্তিতে কোনো তলস্তয় নেই। থাকলে লিখতেন, ‘কতটুকু জমি দরকার ?’। জীবন-মরণ সীমানা ছাড়িয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ভয়াবহ সংকটের মুখে। করোনায় বেঁচে গেলেও পরে আদৌ স্বাভাবিক হবো কি আমরা ?

বিষাদময় আনত নয়নে কবিগুরুকে স্মরণ করি ----

‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্তনা।’

লেখক-
 এম এ কবীর
সাংবাদিক
trynew70@gmail.com















No comments

Powered by Blogger.