“সুখের সন্ধানে” (৭ম পর্ব)

আলহাজ্ব এম. এ. কাদের

(সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)-

প্রতিটি মানুষ প্রশংসা পেতে চায়, গুরুত্ব পেতে চায়, জনপ্রিয় ও সফল হতে চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি অথবা যে কোন পেশার মাধ্যমে মানুষ সফলতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়। মানুষ চায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, সমাজের জন্য কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করতে চায় যা দ্বারা তার প্রশংসা, ভালোবাসা ও সামাজিক গুরুত্ব রক্ষিত হবে। সমাজ তাকে জানুক এবং মানুক এটাই তার কাম্য। একজন মানুষের মানবিক চরিত্র যত জাগ্রত, সে ততো উন্নত। সফল মানুষের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের সাফল্যের প্রধান গুণ ছিল জীবন সম্পর্কে সচেতনতা। পৃথিবীতে আলোচিত মানুষের অভ্যাস ছিল যেকোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সচেতন থাকা। কাজেই প্রতিকূল অবস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রনে এনে  উত্তেজিত বা আবেগ তাড়িত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সুতরাং কেউ যদি সফল ও সুখী হতে চান, জনপ্রিয় নেতা বা নেতৃত্বের চূড়ান্তে যেতে চান তবে তাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত রাখতে হবে। দূরদর্শী ব্যক্তিদের মূল্যবোধ জাগ্রত থাকে। নিজের মনকে ইতিবাচক রাখতে প্রয়োজন নিজেকে চেনা বা উপলব্ধি করা। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বলেছেন, যুদ্ধে হাজার মানুষকে জয় করার চেয়ে নিজেকে জয়ী করাই বড় যোদ্ধার পরিচয়। হিংসা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করে বিজয়ী হতে পারলেই তার পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, মানুষের সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, নিজের খারাপ কাজের সমালোচনা করা। নিজেকে খারাপ অভ্যাস থেকে সরিয়ে রাখা বা সংশোধন করা। বাস্তবে দেখা যায়, সবচেয়ে সহজ কাজ অন্যের সমালোচনা বা বদনাম করা। এ সমস্ত মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলেও পতন হচ্ছে তার ভেতরের বিবেকেরঅ পচন ধরছে তার বুকের ভেতরে থাকা হৃদয়ের। আর এই পচনের কারনে মানুষ হারাচ্ছে মনুষ্যত্ববোধ, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা বাড়ছে পশুত্বের বর্বরতা। সামান্য ছাড় দেওয়ার মন মানসিকতা আমাদের নাই, অন্যের কথায় কান দিয়ে সত্য মিথ্যা না জেনে পান থেকে চুন খসলেই তার পিছনে লাগা, ক্ষতির চেষ্টা করা আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট পরিণত হয়েছে। মানুষ কে সৃষ্টির সেরা বলা হয়েছে তার জ্ঞ্যান, বিবেক বিবেচনার জন্য, কিন্তু এখন তার আচারন দেখে চতুস্পদ প্রাণীরাও লজ্জিত হয়। এক্ষেত্রে আপনি সংশোধিত হতে চাইলে সকাল থেকেই প্রতিজ্ঞা করে  বিছানা থেকে উঠুন এবং অন্যের সমালোচনা না করে তার ভালো কাজের প্রশংসা করুন। দু’এক দিন দৃঢ়তার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকুন, দেখবেন এক সময় আপনিও মার্জিত হয়ে গেছেন। অভ্যাসবশত অন্যের  সমালোচনা আর আপনি করতে পারছেন না। আর এই ভালো কাজ করতে পেরে আপনার নিজেকে অনেক সুখি মনে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে কঠিন পাপ অন্যের সমালোচনা বা গীবত করা। পাপের ধরনে বলা হয়েছে, গীবতকারীর সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে তা পাপে পরিণত হবে। তোমাকে সুখ পেতে হলে, সুখি হতে হলে, তোমার মানসিকতা সরল হতে হবে, জটিল নয়। সবকিছু সহজ ভাবে গ্রহণ করতে হবে। তা হলেই সুখ সহজে পাওয়া যাবে। সুখের সহজ শর্তই হলো সবকিছু সহজ করে নেয়া। চাপ মনে না করা। যত চাপ তত দুঃখ। যত বেশি টেনশন তত বেশি নিরানন্দ, অশান্তি। জীবন যেহেতু একটাই সেহেতু টেনশন, নিরানন্দ দূরে রেখেই জীবনের জন্য সুখের স্বর্গ গড়ে তুলতে হবে। অনেকে অনেক সময় নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অধিক ব্যস্ততার কারণে সুখ অনুভব করতে পারে না। অধিক পরিশ্রমে, এক সময় উচ্চপর্যায়ের ক্যারিয়ার গঠন হলো ঠিকই, কিন্তু সুখের মুল্যবান সময় পার হয়ে গেল, যা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অধিক ধনবান হওয়ার চেয়ে সুস্থ দীর্ঘ জীবন লাভ করা বেশি জরুরী। অধিক ধনবান হওয়ার জন্য অবিরাম পরিশ্রম না করে দীর্ঘ জীবন লাভের জন্য চেষ্টা করা দরকার এবং নিজেকে সে ভাবে গড়ে তোলা উচিত। অনেক কষ্টে উপার্জিত অর্থের ক্রয়কৃত অনেক কিছুরই ৭০% অব্যবহৃত থেকে যায়। নিজের বসবাসের প্রাসাদ বেশির ভাগ অব্যবহৃত থেকে যায়। অনেকেরই এক আলমারী কাপড়-চোপড়ের বেশির ভাগই কোন দিনই পরা হয়ে উঠে না। সারাজীবনের পরিশ্রমের অর্থের বেশির ভাগই সন্তানের সুখের জন্যই রেখে যাওয়া হয়। আপনার কষ্টের, পরিশ্রমের জমানো অর্থ সম্পদ যাদের জন্য রেখে যাবেন বছরে একবারও আপনার কবরের কাছে দোয়া করার সময় হয়তো তাদের হবে না, অথবা যাওয়ার প্রয়োজনটুকুও তারা বোধ করবে না। আপনি কাদের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে খেয়ে-না খেয়ে,  পরিশ্রম করে জমিয়ে রেখে যাচ্ছেন? তারা আপনার মৃত্যুর পর ভাগাভাগি এবং স¦াভাবিক জীবনের কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এমনকি আপনি অসুস্থ থাকলেও আপনার অর্থে বেড়ে উঠা মানুষগুলো আপনার চিকিৎসার দিকে খেয়াল না করে তাদের সুবিধা নেয়ার জন্য আপনার সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করা নিয়ে ভাগাভাগিতে ব্যস্ত থাকতে পারে। কাজেই আপনি বেঁচে থাকতেই ১০০% সুরক্ষা এবং সুস্থ থাকার জন্য আপনার অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করাই শ্রেয়। অসুস্থ না হলেও মেডিকেল চেকআপে থাকুন। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকুন। রাগ পুষে রাখবেন না। মনে রাখবেন কেউ আপনার রাগকে পছন্দ করে না। আপনার সাথে কেউ ছোটখাটো অপরাধ করলে ক্ষমা করে দিন। প্রয়োজনে আপনজনদের কাছে ভাল থাকার জন্য ছাড় দিন। অনেক ক্ষমতাধর হলেও বিনয়ী হোন। ধনী না হলেও অল্পতেই তৃপ্ত থাকুন। সুযোগ পেলেই পরিবার পরিজনদের সাথে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। যতই বয়স হোক আর যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, জীবন সঙ্গীকে  নিয়ে মাঝে মাঝে নিরিবিলি কোথাও হাত ধরে একটু হাঁটুন তাকে বুঝতে দিন সেই আপনার সবচেয়ে আপন। কারণ আপনার সকল দুঃসময়ে সেই আপনার পাশে আছে এবং থাকবে। ভালবাসার ক্ষেত্রে হিসাব করুন কতটা নিলাম সেটা নয়, কতটা দিতে পারলাম। দেবার বেলায় যদি তুমি এগিয়ে থাকো, তাহলে তোমার কখনো মনে হবে না তুমি হেরে গেছো। তাকে মাঝে মাঝে উপহার দিন এবং তার ছোট খাটো দোষ-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটুন এবং সর্বদা হাসি মুখে থাকুন এবং নিজেকে সর্বদা সুখী মনে করুন। পরিবার ও ছেলে-মেয়েদেরকে মাঝে মাঝে সময় দিন। ছেলে-মেয়েদেরকে কাছে নিয়ে আদরের সাথে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান ও জ্ঞানের কথা বলুন। মনে রাখতে হবে আপনার সারাজীবনের সুখের ৮০% ঘিরে আছে আপনার সন্তান। আপনার সন্তানই পারে আপনার মুখ উজ্জ্বল করে সুনাম বৃদ্ধি করতে এবং স্থায়ী সুখ দিতে। সন্তান যদি নষ্ট হয় আপনার যত সুখ সব বিলীন হয়ে যেতে পারে এবং আপনি চির অসুখি হয়ে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতে পারেন। কাজেই সন্তানদের ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার। অবহেলা করলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়েও সমাধান না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মনে রাখতে হবে, অবাধ্য সন্তান আপনার সারা জীবনের সুখ কেড়ে নিতে পারে। ছেলে-মেয়েকে ছোটবেলায় ধর্মীয় শিক্ষা দিলে বেশির ভাগ সন্তান সৃষ্টিকর্তার ভয়ে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। পিতা-মাতাকে, গুরুজনকে সম্মান করতে শিখবে। ভালোটা গ্রহণ করবে খারাপ কাজকে পরিহার করবে। শুধু ¯েœহ-আদর-ভালোবাসা দিয়ে বন্ধুর মত মিশতে হবে তা নয়, শাসনও থাকতে হবে। সন্তান যেন বুঝতে পারে তার অন্যায় কাজগুলো বাবা-মা পছন্দ করে না। সন্তানকে বুঝতে দিতে হবে বাবা-মার শাসনের মধ্যেই তার মঙ্গল। বাবা-মা কোনদিন সন্তানের অমঙ্গল চান না। কঠিন শাসনের মধ্যে নয়, আঠারো বছর পর্যন্ত ছাড়তে হবে চোখে রেখে, চোখের আড়ালে নয়। সন্তানের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে হলে কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে হবে। যে কোন কঠিন কাজ অভ্যাসে পরিণত হলে সহজ হয়ে যায়, তখন তার কাছে আর কঠিন মনে হবে না। তাকে বোঝাতে হবে পরিশ্রম ছাড়া জীবনে বড় হওয়া যায় না।


                                                                                                                                                   Email: makader958@gmail.com

Phone: 01711-338182, 01961-604161

Facebook page: facebook.com/makader1958

 

 

No comments

Powered by Blogger.