স্বল্প হারে কর নির্ধারণ হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে


এম, এ, কাদের-

সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকার যে রাজস্ব আয় করে থাকে, তার বড় একটি অংশ আয়কর খাত থেকে আসে। গত ২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট বাজেট ছিল পাঁচ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের ১৮.৩ শতাংশ অর্থাৎ ১ লক্ষ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকাই আয়কর খাত থেকে আসবে নির্ধারন করা ছিল। আমাদের দেশে আয়কর আইন অনুযায়ী একজন নাগরিকের কর্মজীবন শুরু হলে পুরুষের বাৎসরিক আয় ৩ লক্ষ, মহিলা ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হলে ওই নাগরিক আয়করের আওতায় আসার নিয়ম আছে। আয়কর আইন শিথিলের পর শিথিলযোগ্য আয়ের পরে পরবর্তী ১ লক্ষ টাকার জন্য ৫ % হারে ৫ হাজার টাকা, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকার জন্য ১০% হারে ৩০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৪ লক্ষ টাকার জন্য ১৫% হারে ৬০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকার জন্য ২০% হারে ১ লক্ষ টাকা দেওয়ার নিয়ম আছে। এ হিসাবে বাৎসরিক আয় যদি ১৬ লক্ষ টাকা হয় তবে মোট আয়কর দিতে হবে ১ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। এর উপরে যদি আর মাত্র ৪ লক্ষ টাকা বেশি আয় হয়, অর্থাৎ মোট বাৎসরিক আয় যদি ২০ লক্ষ টাকা হয় তবে আয়কর দিতে হবে ২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। একজন সাধারণ ব্যবসায়ীর পক্ষে সমস্ত খরচ মিটিয়ে উচ্চহারে কর দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এই অধিক হারে আয়কর দেওয়ার নিয়মের কারনেই আয়কর দাতারা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে আয়কর একেবারেই কম দিচ্ছে এবং বৈধপথে উপার্জন হওয়া সত্ত্বেও অপ্রদর্শনের কারণে এ টাকা বৈধতা হারাচ্ছে। আর এ সুযোগেই কিছু মধ্যভোগী-সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। তাছাড়া মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাসযোগ্য আবাসিক বাড়ি বা এপার্টমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ১৯অঅঅঅঅ ধারা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক  ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলখুশা বানিজ্যিক এলাকায় প্রতি বর্গমিটার হিসাবে ৬ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২ শত বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট এপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৩ শত টাকা, এবং জেলা সদরের পৌর এলাকার ২ শত বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট এপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৬ শত টাকা নির্ধারণ করা আছে। সড়ক পথে যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্য বহনকারী ট্রাকের ক্ষেত্রে ধারণ ক্ষমতা ও মডেলভেদে বছরে ৭ হাজার ৫ শত টাকা থেকে ১২ হাজার ৫ শত টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে ১৫০০ সিসি কার ও জিপের জন্য ২৫ হাজার, ২০০০ সিসি পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ৩৫০০ সিসি থেকে যত উপরেই হোক ২ লক্ষ টাকা নির্ধারণ আছে। এছাড়া প্রতিটি মাইক্রোবাসের জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাগরিক তার কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের জন্য সর্বনিু ৫ হাজার, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের জন্য সর্বনিু ৪ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে নথিভুক্ত হতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য এলাকার জন্য সর্বনিু ৩ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে শুরু করলে সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা তার আয়কর নথিতে সাদা টাকা হিসাবে মূলধন দেখানো নিয়ম আছে। এছাড়াও উক্ত নথিতে পৈত্রিক সম্পত্তি যোগ হতে পারে। এরপর তার কর্মজীবনের সমস্ত আয়ের উপর নির্ধারিত কর পরিশোধের মাধ্যমে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ও মূলধন বাড়ার কথা থাকলেও করদাতার আয়কর নথির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার তেমন মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশে লক্ষ লক্ষ যানবাহন (বাস-ট্রাক, প্রাইভেটকার, জিপ, মাইক্রো) এবং একই ব্যক্তির একাধিক গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অনেকের আয়কর নথিতে মূলধন হিসাবে কমমূল্যের দুই-একটি গাড়ি দেখানো আছে। একজন নাগরিকের বাড়ি, গাড়ি, জায়গা, জমি, সম্পদের মূল্য ৫ কোটি টাকা হলেও তার আয়কর নথিতে হয়ত হিসাব দেখানো আছে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা, যা প্রকৃত হিসাবের ১০-১২ ভাগেরও কম। এতে করে সরকার করদাতার কাছ থেকে আয়কর হারাচ্ছে, অন্য দিকে অধিক কর নির্ধারণ করায় করদাতা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে কর দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর বৈধ পথে আয় করা অপ্রদর্শিত টাকা, অধিক হারে আয়কর নির্ধারণের কারণে সাদা টাকা হিসাবে বৈধতা না পাওয়ায়, দেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়াও অবৈধভাবে আয় করা কালো টাকাও অধিকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

একটি উপজেলা শহরে পৌর এলাকাধীন একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ব্যবসায়িক এবং আবাসিক ভবনের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০টি। জমিসহ একেকটি ভবনের মূল্য আনুমানিক ১ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। উল্লেখিত ভবনের মূল্য আয়কর নথিতে ১ কোটি টাকা হলে শতকরা ২ শতাংশ হারে আয়কর ধরে স্থায়ী স¤পদ হিসেবে দেখানোর সুযোগ দিলে তাকে ওই ভবনটির জন্য আয়কর দিতে হবে দুই লক্ষ টাকা। অনেক উপজেলা শহরে ৩০০ ভবনের মধ্যে ১০০ ভবনও আয়কর নথিতে দেখানো নাই। উপজেলা শহরে শুধু ৩০০ বাড়ির সর্বনিম্ন ২% হারে সরকারকে আয়কর দিলে প্রতি উপজেলায় অতিরিক্ত প্রায় ৬ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হবে। একই নিয়মে প্রতি জেলা শহরে কমপক্ষে ১০ গুন হারে আয় হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। তাহলে ৬৪ জেলায় রাজস্ব আয় হবে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। পুরাতন জেলা শহরে এর ১০ গুণ বেশি টাকা কর আদায় হবে। বিভাগীয় শহরে ভবনের সংখ্যা জেলা শহর থেকে অন্তত ১০ গুণ বেশি। তাহলে কর আদায় হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোয় লক্ষ লক্ষ বাণিজ্যিক ও আবাসিক বাড়ির মূল্যকে মূলধন হিসাবে সর্বনিম্ন হারেও আয়কর নির্ধারণ করে আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি করলে সরকারের আয় হবে হাজার হাজার গুণ বেশি অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের উপার্জনক্ষম (কর্মজীবনে) ব্যক্তির জন্য আয়কর নথি একটি আয়না স্বরূপ। প্রত্যেকের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করলে, ওই ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা আয়না স্বরূপ বোঝার দরকার ছিল। বর্তমানে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা শুরু হওয়ায় এবং মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের লাভের হার অত্যন্ত কম। তাছাড়া অনেকের বাৎসরিক আয় থেকে খরচও অনেক বেশি। করদাতার কাছে করের হার অত্যন্ত বেশি হওয়ার কারণে সে কর দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ও বিক্রয়ের উপরে অধিক হারে ভ্যাট নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। করোনার প্রভাবে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পোল্ট্রী হ্যাচারীগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। অনেক করদাতার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, সরকার সর্বনি¤œ হারে কর দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলে, তারা বৈধপথে অপ্রদর্শিত আয়ের আয়কর দিয়ে সমস্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার প্রদর্শন করে দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে চায়। সরকার স্বল্প হারে কর নির্ধারণ করলে প্রকৃত আয় প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় অনেকগুণে বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বৈধ পথে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করার সুযোগ পেলে দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে বন্ধ হবে। তাছাড়া করদাতা স্ব-ইচ্ছায় কর দিলে পরামর্শদাতা, মধ্যভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বন্ধ হবে এবং সবাই স্ব-ইচ্ছায় কর দিতে উৎসাহিত হবে।

দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজস্ব আয়ের আর কোন বিকল্প নাই। কাজেই সাধারণ ব্যবসায়ীদের করের হার শিথিল করে সর্বনিম্নহারে কর নির্ধারণ করে বৈধ পথে উপার্জিত অপ্রদর্শিত সম্পদ প্রদর্শন করার সুযোগ দিলে সরকারের আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ফলে অপ্রদির্শত আয় প্রদর্শনে বৈধতা পাবে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এতে করদাতা প্রতি বছরই স্ব-ইচ্ছায় তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। এছাড়াও সহজ শর্তে সর্বনিম্নহারে কর নির্ধারণ করলে নতুন করদাতার সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে, ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ৪৫ শতাংশের জায়গায় ১০০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, অবৈধ পথে আয়, ধারাবাহিকতা না থাকা, আয়ের উৎস না থাকা, অধিক হারে অপ্রত্যাশিত আয় দেখানো বা ইতিপূর্বে আয়কর নথি না থাকা, এদের এ সুযোগের আওতায় আনা যাবে না। দুর্নীতিবাজরা এ সুযোগের আওতায় আসলে অতি উৎসাহিত হয়ে কালোটাকা, সাদা করার সুযোগ নিতে পারে। প্রায় প্রতি অর্থবছরেই অধিক কর নির্ধারণ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া সাধারণ জনগণ এ সুযোগ নিতে পারে না। সহজ ও সর্বনিম্ন কর নির্ধারণের বিষয়টি অভিজ্ঞজনের বিচার বিশ্লেষণে এনে, জটিলতা এড়িয়ে স্বচ্ছ আইনের মাধ্যমে কর নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি হলে, দেশের সচেতন সুনাগরিক নিজ ইচ্ছায় প্রতি বছর তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দিতে উৎসাহিত হবে। ফলে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে দেশের প্রবৃদ্ধিও অনেক হারে বৃদ্ধি পাবে। অধিক হারে সরকারের উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলে, উন্নত বিশ্বের ন্যায় দ্রুত দেশের উন্নয়ন সহজ হবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশকে উন্নত রাষ্টে পরিণত করার স্বপ্ন ২০৪১ সাল নয়, এর অনেক আগেই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।


সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

B‡gBjt makader958@gmail.com




No comments

Powered by Blogger.