পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংসের কারণ ও প্রতিকার

 আলহাজ্ব এম.এ. কাদের-

দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য মুরগী উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই।  তাছাড়া বেকার সমস্যা দূরীকরণেরও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্প আশির দশকে শুরু হলেও মুলতঃ ২০০০ সালের পর থেকে এর বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। 

এই শিল্প ধ্বংস হওয়ার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদন, পোল্ট্রী চাষে বিদেশী কো¤পানীদের অনুপ্রবেশ, শুধুমাত্র রান্নার মাংস হিসেবে ব্যবহার করা, বিদেশে রপ্তানী না করা, উৎপাদিত মুরগীর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য না থাকা ও রোগ নির্নয়ের জন্য ডাক্তার-ল্যাবরেটরি না থাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে করোনার প্রভাব, মুরগীর মাংসের উপকারিতা স¤পর্কে ভোক্তার ধারণা না থাকা, মুরগীর খাদ্য, ঔষধ-ভ্যাক্সিন, অন্যান্য উপকরনের অধিক মূল্য বৃদ্ধি এবং বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারী কৃষি ভিত্তিক হলেও ব্যাংক ঋণের লভ্যাংশ ও বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক হারে নেওয়ার কারনে পোল্ট্রীশিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। 

প্রোটিনের উৎস হিসেবে উন্নত বিশ্বে যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকা বছরে একজন মানুষ গড়ে মাংস খায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। মালয়েশিয়ায় প্রতিজন গড়ে বছরে মুরগীর মাংস খাচ্ছে ৪০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে প্রতিজন মুরগীর মাংস খায় বছরে মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রয়লার এবং লেয়ার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টি। আমাদের দেশে শুধু ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ পিস। যা দিয়ে মাংস উৎপাদন হচ্ছে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন কিন্তু প্রতিদিন চাহিদা আছে মাত্র দুই হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে প্রতিদিন উৎপাদন বেশি হচ্ছে প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন। একারণেই উৎপাদনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে ব্রয়লার মুরগীর দাম পাচ্ছে না। 

উন্নত দেশের মানুষ আমাদের দেশের তুলনায় মুরগীর মাংস খায় ৮ থেকে ৯ গুন বেশী, ডিম খায় ৭ থেকে ৮ গুণ বেশী। দেশে মুরগীর মাংস এবং ডিমের চাহিদা এত কম থাকা সত্ত্বেও  ভ্রান্তনীতির কারণে ইতোমধ্যে বিদেশী কোম্পানীগুলো দেশে প্রবেশ করে, পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংস করার জন্য জোরে-সোরে ব্রয়লার বাচ্চা, ডিম ও কমার্শিয়াল মুরগী উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে থাইল্যান্ড কোং সিপি বাংলাদেশ, চায়নার নিউহোপ, ইন্দোনেশিয়ার জাফপা এবং ভারতের সগুনা ও ভেনকিজ। বিদেশী এই সমস্ত কোম্পানিগুলো প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদন করছে প্রায় ৬ লক্ষ পিস। 

বর্তমানে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন খরচ প্রায় ৩২ টাকা থেকে ৩৩ টাকা হলেও বিদেশী আগ্রাসন এবং অধিক উৎপাদনের কারণে গত প্রায় ৪ বছরের বেশী সময় ধরে (১ জুলাই ২০১৭ থেকে এই পর্যন্ত) ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রয় হচ্ছে মাত্র ১০ টাকা থেকে ২০ টাকার মধ্যে। এই বিরাট লোকসানের কারণে কিছু হ্যাচারী ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, বাকী গুলো বন্ধ হওয়ার পথে। অনুসন্ধানে মুরগীর মাংস না খাওয়ার কারণ সম্বন্ধে জানা যায়, কোন এক প্রচার মাধ্যমের অপপ্রচারের জন্য মুরগীর মাংস না খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। মুরগীর খাদ্য তথাকথিত ট্যানারী বর্জ্যদ্রব্য দিয়ে প্রস্তুত করা হয়, এ কারনে পোল্ট্রি মুরগী মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আসলে বিষয়টি কতটুকু সত্য, এটা বিচার-বিবেচনায় আনা হয়নি। বিগত কোন একদিন, কোন অসাধু ব্যবসায়ী ট্যানারী বর্জ্য ব্যবহার করতে  পারে, তার মানে এই নয় যে, তার ধারাবাহিকতা এখনও চলে আসছে। যাই হোক, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই এই অসাধু ব্যবসায়ীদের আর এগুতে দেবে না, এটাই আমাদের বিশ্বাস। দেশে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ পিস মুরগী উৎপাদন হলেও রোগ নির্নয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা ল্যাবরেটরী নেই। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মুরগীর মাংসের মাধ্যমে প্রোটিনের অভাব দূর করা সম্ভব। চাহিদা মত মুরগীর মাংস খেলে প্রোটিনের অভাব পুরণের মাধ্যমে নিউরোট্রান্সমিটার সঠিকভাবে কাজ করবে। এতে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, কাজের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

গত ২০ বছরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারনে মুরগীর খাবার, ভ্যাকসিন, ঔষধ সরঞ্জামাদির দাম বর্তমানে ৭ থেকে ১০ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া জনশক্তির মূল্য বেড়েছে ৫ থেকে ৭ গুণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত ২০ বৎসরে মুরগীর চাহিদা না বাড়ায় দামের তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি। মৃতপ্রায় পোল্ট্রীশিল্প রক্ষার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (প্রাণী সম্পদ) কে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনিয়ন্ত্রিত পোল্ট্রি শিল্পকে শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে। বিদেশী যে সমস্ত বড় বড় মুরগীর ফার্ম আমাদের দেশে জেকে বসেছে, সে গুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হ্যাচারীগুলোকে অবশ্যই শৃংখলার মধ্যে থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা উৎপাদন করতে হবে, অথবা উৎপাদনের সাথে মিল রেখে মুরগীর মাংস বিদেশে রপ্তানী করতে হবে। হ্যাচারীর উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য প্রতি পিস কমপক্ষে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা ও উতপাদিত মুরগীর দাম কমপক্ষে ২০০ টাকা প্রতি কেজি নির্ধারণ করতে হবে। দেশের মানুষের মুরগীর মাংস খাওয়ার উপকারীতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মত বিভিন্ন খাবারের সাথে মুরগীর মাংস সংযুক্ত করে দেশে-বিদেশে রপ্তানী করতে হবে। 

দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোল্ট্রি শিল্প বিরাট ভ’মিকা রাখতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানী করলে এই শিল্প প্রসারের সাথে সাথে অনেকাংশে বেকার সমস্যা দূর করা সহ প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। কাজেই এ শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, এখনই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সু-পরিকল্পিত ভাবে পোল্ট্রিনীতি বাস্তবায়িত হলে মৃতপ্রায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। এতে বেকার সমস্যা দূর হবার সাথে সাথে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

 Email:makader1958@gmail.com                                              




No comments

Powered by Blogger.