ঝিনাইদহে কর্মসৃজন প্রকল্প বরাদ্দ ১৬ কোটি , তালিকায় ব্যবসায়ী প্রবাসি চাকরীজীবী

 

 ঝিনাইদহ  প্রতিনিধি-

ঝিনাইদহে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প ‘কর্মসৃজন’ লুটপাটের  কর্মসূচিতে পরিনত হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানরা পিআইওদের সহায়তায় যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছেন। ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারও বিষয়টি দেখভাল করছেন না। ফলে প্রকল্পের শ্রমিকের তালিকায় প্রবাসী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্বচ্ছল ব্যক্তি কিংবা চেয়ারম্যান মেম্বরের স্বজনের নাম বসিয়ে সরকারী টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। ব্যাংক থেকে তাদের নামে উঠে যাচ্ছে প্রকল্পের টাকা। 

এ প্রকল্পে হরিণাকুন্ডু উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে প্রথম দফায় ৮০ দিনের কর্মসূচির জন্য ৪৮টি কল্পের অনুকূলে এক হাজার ২১২ জন শ্রমিকের দিন হাজিরার মজুরি বাবদ ১ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এই টাকা ভূয়া শ্রমিকের নামে তুলে নেয়া হয়েছে। হরিণাকুন্ডুর মান্দিয়া গ্রামের রইচ উদ্দিন থাকেন সৌদিতে। খাতা কলমে রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মাঠ আন্দুলিয়া মাঠের পাকা ড্রেন সংস্কার প্রকল্পের তালিকাভুক্ত শ্রমিকদের সরদার তিনি। চরপাড়া গ্রামের মিল্টন হোসেন ইউনিয়ন তথ্য সেবায় কাজ করেন। একই গ্রামের মামুনুর রশিদ ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকে চাকরি করে। ওই ইউনিয়নের আবদুল হাকিম দর্জি ও মতিয়ার রহমান বিত্তশালী হলেও কর্মসুজন প্রকল্পে শ্রমিকের তালিকায় তাদের নাম। এছাড়া চরপাড়া বাজারের নরসুন্দর শ্রী স্বপন কুমার দাস ও আব্দুল লতিফ ঢাকায় বসবাস করেন। কর্মসৃজনের শ্রমিক মিরাজ উদ্দিন পেশায় দোকানদার। ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী নায়েব আলী। এনামুল হক গ্রামের পশু চিকিৎসক। সাইদ হাসান রনি ও সাগর হোসেন চাকরি করেন। সুশান্ত কুমার ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার। মহিউদ্দিন মেকানিক। রাশিদুল ইসলাম চায়ের দোকানদার। রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সাবেক নিত্যানন্দপুর গ্রামের শরিফ আল আমীন ঝিনাইদহ শহরে পাকাবাড়িতে বসবাস করেন। চরপাড়া গ্রামের পায়রা খাতুনের নাম কর্মসৃজন প্রকল্পে রয়েছে। তবে এ খবর তাদের জানা নেই। এ ভাবে ভূয়া নাম বসিয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা হরিলুট করা হচ্ছে। কর্মসৃজনের প্রকল্পের তালিকাভুক্ত শ্রমিক আনোয়ারা খাতুন (৫০) অভিযোগ করেন, কাজ করার পর মেম্বর তার কাছ থেকে সাতশ টাকা জোর করে কেটে নিয়েছে। তার স্বামী মজিবর পঙ্গু। ব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, সপ্তাহে ৫ দিনে এক হাজার টাকা করে ৪০ দিনে আট হাজার টাকা মজুরি পান শ্রমিকরা। সর্বমোট ৮০ দিনে পান ১৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের সরদারের মজুরি প্রতিদিন ২৫০ টাকা করে সপ্তাহে ১২০০ টাকা। 

জানা গেছে, হরিণাকুন্ডু উপজেলার ৭নং রঘুনাথপুর ইউনিয়নে দ্বিতীয় ধাপে ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। প্রতিটি প্রকল্পে ৫৮ জন করে ১৭৪ জন শ্রমিকের নাম তালিকায় রয়েছে। কিন্তু কাজ যথাযথ ভাবে হয়নি। এ বিষয়ে রঘুনাথপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বর আবদুল কুদ্দুস বলেন, গরিব মানুষের হিসাববোধ নেই। ওরা মিথ্যে কথা বলে। কাজ না করে টাকা নেয়। আমার সামনে কেউ কথা বলতে পারবে না। একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হাসেম আলী বলেন, তালিকাভুক্ত সব শ্রমিক কাজ করে না। বৃষ্টির কারণে প্রকল্পের কাজ হয়নি। হরিণাকুন্ডুু উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের ওয়ার্ড মেম্বর সোহরাব হোসেন ওরফে সাহেব আলী কর্মসৃজন কর্মসূচির ২৫ জন শ্রমিক দিয়ে নিজের বাড়ির রাস্তা করেছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান রাকিবুল হাসান রাসেল জানান, তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যে বানোয়াট অভিযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসীর নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। হরিণাকুন্ডু উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা  জামাল হুসাইন বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সুপারভাইজার) হাবিবুর রহমান বলেন,তালিকাভুক্ত সব শ্রমিক কাজ করেনি এমন অভিযোগ নেই। তবে সব সময় প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। অপরদিকে কালীগঞ্জ উপজেলায় শ্রমিকের সংখ্যা এক হাজার ৫০৯ জন। চলতি অর্থবছরে দুই ধাপে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই কোটি ৪১ লাখ টাকা। একই ভাবে সদর উপজেলায় দুই হাজার ২০৭ জন শ্রমিকের জন্য দুই কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার। শৈলকুপা উপজেলায় দুই হাজার ৪৪১ জন শ্রমিকের মজুরি বাবদ দুই কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। মহেশপুর উপজেলায় এক হাজার ৯০৮ জন শ্রমিকের জন্য তিন কোটি চার লাখ টাকার বেশী এবং কোটচাঁদপুরে ৫৭৯ জন শ্রমিকের জন্য ৯২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যে প্রথম ধাপে কাজের কাজ হয়নি। অথচ ব্যাংক থেকে দিন হাজিরার টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। মাস্টার রোলে টিপসইও দেখানো হয়েছে। ওই টিপ সই প্রকৃত শ্রমিকই দিয়েছে কিনা তা যাচাই করেনি সংশ্লিষ্ট পিআইও অফিস। তবে শ্রমিকের চেক বইয়ে আগাম স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে,এমন প্রমাণ মিলেছে। কালীগঞ্জ ও শৈলকুপা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ-হেল-আল-মাসুদ বলেন, তালিকাভূক্ত শ্রমিক নিজের টাকা অন্যকে দিয়ে দিলে আমার কিছুই করার থাকে না। সপ্তাহে দু-একদিন কর্ম সৃজনের কাজ পরিদর্শন করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে কাজ হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন। মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেরুন নেসা বলেন, কর্ম সৃজন প্রকল্পের কাজ ১০ জুন শেষ হয়েছে। অনুপস্থিত শ্রমিকদের মজুরির টাকা কেটে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হবে বলে তিনি জানান। ঝিনাইদহ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা বজলুর রশিদ জানিয়েছেন,টাকা সরাসরি তালিকাভুক্ত শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়ে থাকে। সেই টাকা শ্রমিকরা চেক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সরাসরি তুলতে পারেন। তবে শ্রমিকের টাকা কেউ তুলে নিয়ে থাকলে কিছুই করার নেই তার। সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম ধাপে ৭ কোটি ৮৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় ধাপেও অনুরূপ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দুই দফায় ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বিপুল অঙ্কের এ অর্থে ৯ হাজার ৮৫৬ জন শ্রমিকের বছরের অন্তত ৮০ দিন কর্মসংস্থান হওয়ার কথা।


No comments

Powered by Blogger.