ঠেকানা যাচ্ছে না কোন ভাবেই ঝিনাইদহে বাল্যবিয়ে বেড়েছে আশংকাজনকহারে

এম এ কবীর,ঝিনাইদহ -

দিন মজুরের মেয়ে সাথী মনিকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বসতে হয় বিয়ের পীড়িতে। বয়স কম হওয়ায় বিয়ে হয় কালীগঞ্জ শহরে। অষ্টম  শ্রেণির ছাত্রী সাথী মনির বিয়ের পর শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। এখন আর সাথী মনি স্বামীর কাছে যেতে চায় না।

সাথী মনির পিতা জানান, দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ। পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেরা ঝামেলা করে। মেয়েও ঠিক মতো পড়তে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে মেয়ে বিয়ে দিতে হয়। এখন সে আর স্বামীর কাছে যেতে চায় না। একইভাবে গোবিন্দুপর গ্রামের রমেচা খাতুনকে (ছদ্মনাম) মাত্র সাড়ে ১৩ বছর বয়সে বসতে হয় বিয়ের পীড়িতে। বিয়ের দিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বংকিরা পুলিশ ফাড়ির সদস্যরা বর পক্ষকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। বিয়ে না করার শর্তে থানায় উভয়পক্ষ মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়। গোপনে তারা সেই মেয়েকেই আবার বিয়ে করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সাথী মনি ও রমেচা খাতুনের মতো কিশোরীদের এখন ঠাঁই হচ্ছে স্বামীর ঘরে। যে বয়সে স্কুলের মাঠে হৈ হুল্লোড় আর পড়ালেখা করে সময় কাটানোর কথা সে বয়সে ‘সংসার’ নামে এক অজানা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করছে।

এমন এক কিশোরী ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না মাঝেরপাড়া গ্রামের ইয়াসমিন। নিজ গ্রামের একই বয়সী ছেলে আশিকুল ইসলামের সঙ্গে  প্রেম করে বিয়ে করে ইয়াসমিন। বিয়ে মানতে নারাজ ছেলের পিতা জাহিদুল ইসলাম।  প্রেমের বিয়ে মেনে নিতে না পারায় হতাশাগ্রস্ত ইয়াসমিন বিষপানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সদরের গোবিন্দপুর ও হরিণাকুন্ডুর দারিয়াপুর গ্রামে অপ্রাপ্ত বয়সী ছাত্র-ছাত্রীরা প্রেমের সম্পর্ক করে বাড়ি ছাড়া হয়। বয়স না হওয়ায় স্থানীয় চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে তারা বাড়ি ফিরে আসে। হরিণাকুন্ডুর ভাতুড়িয়া গ্রামের কলেজ পড়ুয়া যুবকের সঙ্গে একই এলাকার দশম  শ্রেণির ছাত্রী পালিয়ে ঘর বাধে। মেয়ের বয়স কম হওয়ায় তাদের বিয়ে রেজিষ্ট্রি হয়নি। মেয়ের পক্ষ এখনো বিয়ে মানতে নারাজ। সদর উপজেলার সুরাট গ্রামের এক ভ্যান চালকের  প্রেমে পড়ে কোটচাঁদপুরের এক স্কুলছাত্রী ঘর ছাড়ে। একইভাবে সাতক্ষীরা শহরের এক স্কুলছাত্রী পালিয়ে এসে মিয়াকুন্ডু গ্রামে এসে ওঠে। এভাবে জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে অসম  প্রেম আর বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়েছে। করোনাকালে অলস জীবন, মোবাইল ও ইন্টারনেট সুবিধার কারণে টিনএজারদের বিপথগামী করছে বলে জানান শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ অলোক কুমার।বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লক্ষি রানী জানান, তার স্কুলের দুই ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। তবে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও গোপনে বাল্যবিয়ের খবর আসছে। করোনাকালীন সময়ে যৌথ পরিবারে বসবাস করতে গিয়ে অনকে সময় ঝগড়া- মনোমালিন্যও হচ্ছে।

ঝিনাইদহ শহরের ব্যপারীপাড়া, হামদহ ও আদর্শপাড়ার মহিলা ছাত্রীনিবাসের মালিকরা জানান, করোনা মহামারির কারণে তাদের মেসের প্রায় সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন প্রতিটা মেসে নতুন নতুন মেয়ে আসছে। গ্রামাঞ্চলে খুব গোপনীয়তার সঙ্গে বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। প্রশাসন ও পুলিশ সক্রিয় থাকায় এক জেলা থেকে অন্যজেলায় নিয়েও বিয়ে হচ্ছে।

ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সী ফিরোজা সুলতানা জানান, বাল্যবিয়ের হার কমাতে আমরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সেই উদ্যোগও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মহামারি করোনা আমাদের সে সাফল্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় একদিকে অল্পবয়সী ছেলেরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কৃষি কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। তারা ২১ বছরের আগেই বিয়ে করে বসছে।

অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকরা হতাশ ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনলাইনে ক্লাস করারও সুযোগ পাচ্ছেনা এসব ছেলে মেয়েরা। সঙ্গত কারণেই তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বইপত্রের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলছে। এসব অভিভাবকরা তাদের দৃষ্টিতে ভালো পাত্র পেলেই অতি গোপনীয়তার সঙ্গে কিশোরী মেয়েকে পাত্রস্থ করছেন। অল্পবয়সী এসব মেয়ে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক ও মানসিকভাবে খাপ খাওয়াতে না পেরে সংসারে বিমুখ হয়ে স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে আবার ফিরে আসছে পিতার ঘরে। এতে করে সংকট আরো বাড়ছে।

তিনি জানান, এ সংকট মোকাবিলায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত কিশোর-কিশোরী ক্লাব সমূহ। ক্লাব প্রশিক্ষক ও জেন্ডার প্রমোটাররা তাদের এসব সংকট উত্তরণে পথ দেখাচ্ছেন।

ঝিনাইদহের সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে মূলত এই সমস্যাটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া। মোবাইল ও ইন্টারনেট এক্সেসের কারণে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা  প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা ছেড়ে মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে পিতা মাতার সঙ্গে ঝগড়া বা বাগবিতন্ডায় লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েকে সংসারের বোঝা মনে করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।

মানবাধিকার কর্মী টুকু জানান, তার নিজ গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ের এমন দশ স্কুলছাত্রীর  বিয়ের খবর তিনি পেয়েছেন। এছাড়া প্রায় তিনি বাল্যবিয়ের খবর শুনে ছুটে যাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকায়।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারিতে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি দেখার হার। বেড়েছে আসক্তি। গত বছর থেকে তেমনই বলছে নানা পরিসংখ্যান। অতিমারির কারণে ঘরবন্দি থাকার ফলে বেড়েছে নেটমাধ্যম বা অনলাইনে সময় কাটানোর প্রবণতা। এরই সূত্র ধরে উঠে আসে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তিও।

মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গের মতে, গত এক বছরে অনলাইনে তিন ধরনের কাজের মাত্রা বিপুলভাবে বেড়েছে। সেটা হচ্ছে জুয়া খেলা,অনলাইনে কেনাকাটা এবং পর্নোগ্রাফি দেখা। পর্নোগ্রাফি অতিরিক্ত দেখার ফলে বয়ঃসন্ধির অনেকের পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে।

ব্র্যাকের গবেষণা সূত্রমতে, করোনা মহামারির মধ্যে দেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা এবং বিদেশ থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়াও বাল্যবিবাহের কারণ।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ডাঃ জাহিদ আহমেদ জানান, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মাঠকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। তারা করোনা সচেতনতার পাশাপাশি বাল্যবিয়ের ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলছে।

তিনি বলেন, আমরা খবর পাওয়া মাত্রই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করছি। এরপরও যদি গোপনে কোনো অভিভাবক বাল্যবিয়ে দেয় সেটা আমাদের অজান্তেই ঘটছে।


No comments

Powered by Blogger.