দেশের গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্বের পরম্পরা

                              মতামত


এম এ কাদের-

আজ ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৭ সাল থেকে সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রচলিত বিশেষ দিনটি প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। গণতন্ত্র হলো একটি শাসন ব্যবস্থা; যেখানে আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি প্রণয়ন করতে জনগণ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসে নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষিত হয়। ফলে নাগরিকরা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতি অনেকটাই আস্থাশীল। তবে বিভিন্ন দেশে এ গণতন্ত্রের স্বরূপে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এ শাসন ব্যবস্থার মূল দর্শন হচ্ছে শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। গণতন্ত্রে শাসক নির্বাচনের মূল মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। উল্লেখিত মানদন্ডে বিচার করলে বলতে হয় যে, আমাদের দেশে কখনও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছিল না, এখনও নেই এবং ভবিষ্যতে সেটি কতটুকু হবে সে বিষয়েও আশাবাদী হওয়ার সুযোগ সীমিত। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাশা বিরাজ করছে। 

আমাদের দেশে বৃহৎ ৩টি রাজনৈতিক দলের কাছে গণতন্ত্র একেবারেই অসহায়। বর্তমান প্রধান দুটি দলের বক্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এ দুটি দল পালাক্রমে দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছে। কিন্তু তাদের শাসনকালে কি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগানে জীবন দিয়ে আন্দোলন বেগবান করেন। তার ফলশ্র“তিতে ১৯৯০-এর গণ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির বিতর্কিত নির্বাচন, ২০০৬ সালের সহিংস ঘটনা, ২০১৪ সালের ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনÑএদেশের কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কাম্য ছিল না। নব্বইয়ে এরশাদ সরকারের পতনের পর আমরা কি-গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি? ২০০৬ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ফখরউদ্দীন-মঈন ইউ. আহম্মেদ কি আমাদের সঠিক গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পেরেছেন? এখনও পর্যন্ত কি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? হয়তো হয়নি, আগামী কতদিনে সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে তাও বলা মুশকিল।

মুখে সব দল গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে ক্ষমতায় এসে তারা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং দলের মধ্যে সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। দেশে যত অনিয়ম দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক চর্চায় ছেদ, হত্যাকান্ডসহ অপকর্ম সংঘটিত হয়, তার সঙ্গে যুক্তরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে যান।

সব কথা বলা না গেলেও দিনের আলোর মতো সত্য যে, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা না গেলে কোনোদিনই সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ সব অপকর্মের হোতা দুর্নীতি। স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে, এমনকি এখন পর্যন্ত দেশে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের নিকটাত্মীয় এবং তাদের চতুর্দিকে ঘিরে থাকা লোকজন রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান। এসব ব্যক্তি যেখানেই অর্থ উপার্জনের সুযোগ পান সেখানেই হানা দেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও মাসোয়ারা আদায় করে অতি সহজে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যায় একটি মহল। আমরা অনেকেই অনেক সময় বলে থাকি আগে গণতন্ত্র ছিল, ছোট-বড়র সম্মান ছিল, নেতা বা জনপ্রতিনিধি ভালো ছিল, আসলে বিষয়টি কি সত্যি? সত্য মিথ্যার বিষয়টি আমরা যাচাই করে দেখি না। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর শিক্ষার হার যখন একবারেই কম ছিল, মানুষ যখন এত সচেতন ছিল না, তখনও জনপ্রতিনিধির লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি না থাকলেও জোতদারের আত্মীয়স্বজন, সহচর এরাই সরকারি সম্পত্তি, জমিদারের জমি, রেল কোম্পানির সম্পদ, খাল-নদী দখল, খাস জমি ও চর দখল, এমনকি জনগণের চলাচলে বিঘœ ঘটিয়ে সরকারি রাস্তার পর দোকান-পাট, বাড়িঘর তৈরি করে উচ্চবংশের নামজারি করে এখনও জোতদাররা বহাল তবিয়তে আছেন।

বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও এ ধারাবাহিকতা থেকে এখনও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। যারা গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন, গণতন্ত্র তাদের কাছেই জিম্মি; গণতন্ত্র নামটি তাদেরই দখলে। আজও দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিরপেক্ষ, যোগ্য জনপ্রতিনিধি নেই। যেমন বাজারে যার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, সেই ব্যক্তি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্কুল-কলেজের পরিচালনা কমিটিও অশিক্ষিত ও অযোগ্য প্রতিনিধিদের দখলে। এইভাবে অযোগ্যদের দাপটে যোগ্যদের স্থান হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর বড় বড় কিছু ঘটনা এ দেশের মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা, বিভিন্ন সময় গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যা, জনগণের মিটিং মিছিলে হামলা, মতামত প্রকাশে বাঁধা, হত্যা, খুন, গুমসহ অহেতুক রাজনৈতিক হয়রানি এগুলো গণতন্ত্র ধ্বংসেরই নামান্তর।

দেশে গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য যারা জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করে আন্দোলন-সংগ্রামের নামে শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘœ ঘটায়-মূলত তারাই গণতন্ত্র হত্যাকারী। এসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র বাস্তবায়নের ধোঁয়া তুলে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের সুবিধামতো একনায়কতন্ত্র কায়েম করে বিভিন্নভাবে বিরোধী দলকে ধ্বংস করার মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এটাই এদেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের বাস্তব চিত্র।

প্রকৃত গণতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বৃহৎ দলগুলোকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা আসলেই দেশে গণতন্ত্র চান কি না। প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক ও নির্দলীয় সরকার নিয়ে হুড়োহুড়ি, মারামারি, রশি টানাটানি করে জনগণের ক্ষতি না করে দেশের বৃহৎ দলগুলোর মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে নির্বাচন পরিচালনা করলে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। এতে কোনো দলের অভিযোগ বা আপত্তি থাকার কথা নয়। এ সিদ্ধান্তে একমত হয়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করলে দেশের মানুষ বড় ধরনের সংঘাত থেকে রক্ষা পাবে। এ নিয়মে জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের সব নির্বাচন বাস্তবায়ন করলে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে ধারণা করা যায়।

দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান বাঁধা দুর্নীতি। দুর্নীতি কমলেই যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে এবং দলের মনোয়নের জন্য অযোগ্য, অসৎ লোকদের ভিড় কমে যাবে। নিরপেক্ষ ভোটের জন্য তত্ত্বাবধায়ক, নির্দলীয় সরকারের দরকার হবে না। এমনিতেই যার ভোট তিনি নিজে যাকে খুশি তাকে দিতে পারবেন। এতেই দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে; বন্ধ হবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালান, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভর্তি বাণিজ্য, সোনা চোরাচালান, বিদেশে অর্থ পাচার, শেয়ার কেলেংকারি, কোচিং বাণিজ্য, অফিস আদালতের হয়রানি, অযোগ্যদের যোগ্যস্থান দখল, নারী নির্যাতন, গুম-খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধ। ফলে দেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে এতে সন্দেহ নেই।


সাংবাদিক ও কলামিস্ট

B‡gBjt makader958@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.